১২ রুশ তরুণীই ছিল পাপিয়ার টোপ !!
মাদক ব্যবসা, অভিজাত হোটেলে তরুণী সরবরাহ, অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে গ্রেফতার যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মতি সুমনকে তিন মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ উর রহমান এ আদেশ দেন। পাপিয়ার নানা কুকীর্তি ইতোমধ্যেই দেশের নানা সংবাদমাধ্যমে আসা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেন। যেখানে উল্লেখ করা হয়, ১২ রাশিয়ান তরুণীকে ব্যবহার করে ভিআইপিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিত পাপিয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ রাশিয়ান তরুণীকে ব্যবহার করে ‘ফাঁদে ফেলে’ ভিআইপিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিন পাপিয়া নিজেই এ তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। পাপিয়াকে উদ্ধৃত করে তারা জানিয়েছেন, বিশেষ ক্যামেরা ব্যবহার করে ভিআইপিদের ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ ভিডিওচিত্র করে রাখা হতো। পরে ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের অর্থ। তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, এসব কাজে পাপিয়াকে সহায়তা করতেন তার স্বামী সুমন চৌধুরী। বিমানবন্দর থানায় গতকাল মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দিনভর পাপিয়া-সুমন দম্পতিকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ সময় ঘনিষ্ঠ অনেক ভিআইপির নামও প্রকাশ করছেন তারা। আর এসব তথ্য পেয়ে বিব্রত হচ্ছেন তারা।
এদিকে পাপিয়া-সুমন দম্পতিকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে র্যাব। দুয়েক দিনের মধ্যেই র্যাব হেফাজতে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে বলে জানা গেছে। র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘থাইল্যান্ডের ব্যাংককে একাধিক ব্যাংকে পাপিয়ার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে ওইসব অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে তা এখনো জানা যায়নি। পাপিয়া দম্পতি বিদেশে টাকা পাচার করার কথা স্বীকার করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশেও তার বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুমন চৌধুরী অস্ত্র বিক্রির সঙ্গেও জড়িত। সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে তাদের একাধিক চক্র আছে। এছাড়া পাপিয়া ইয়াবার চালান নিয়ে আসার কথাও স্বীকার করেছেন।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা গতকাল সে জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘পাপিয়া আসলেই হাইপ্রোফাইল। নামিদামি এমন কোনো লোক নেই যার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। জিজ্ঞাসাবাদে তারা যাদের নাম বলছে সবাই সমাজের নামিদামি ব্যক্তি। এসব তথ্য পেয়ে আসলে আমরা বিব্রত।’ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পুলিশের উত্তরা ডিভিশনের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন পাপিয়া। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেন। প্রতারণা কাজে মূলত তরুণীদের ব্যবহার করতেন পাপিয়া। মাসখানেক আগে রাশিয়ার ১২ তরুণীকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাদের আনতে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সহায়তা করেছেন বলে তিনি আমাদের জানিয়েছেন। পাপিয়ার অপরাধ জগতের সঙ্গে আর কারা কারা সম্পৃক্ত তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’
র্যাব-১ অধিনায়ক শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘পাপিয়াসহ অন্যদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে আগ্রহী। কারণ এখনো আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দেননি পাপিয়া। তিনি বড় মাপের মাফিয়া। তাকেসহ অন্যদের যারা সহায়তা করেছে তাদের নাম উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের নাম পেয়ে যাব।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে অবৈধ পন্থায় বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন পাপিয়া ও সুমন। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট কিনে হয়েছেন অন্তত কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। দেশে গাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি বিদেশে দিয়েছেন বার। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও যৌন ব্যবসাই তাদের মূল পেশা। গ্রেপ্তারের পর র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া জানিয়েছিলেন, মাস ছয়েক আগে নরসিংদীতে দোতলা একটি বাড়ি তৈরি করেছেন। পাপিয়া ও সুমনের আলাদা গ্রুপ আছে। তাদের সহায়তা করতেন স্থানীয় নেতারা। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অনেকে অতিষ্ঠ থাকলেও প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না বলেও র্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তারা। এ প্রসঙ্গে র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা মূলত ছিলেন প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের অনুসারী। কিন্তু বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল তাদের বিরোধী ছিলেন। পরে স্থানীয় এক নেতার মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন। তারপর থেকে তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আজ (গতকাল) তাদের পুলিশই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমাদের হেফাজতে নিতে আজ (গতকাল) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। আশা করি দুয়েক দিনের মধ্যে পাপিয়া ও সুমনসহ গ্রেপ্তারদের র্যাবের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, ‘যুব মহিলা লীগের বিতর্কিত নেত্রী পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী ঢাকা ও নরসিংদীতে অবৈধ কাজ-কারবারের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তাদের ওইসব অপকর্মের পরিধি থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। আর গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের মনোরঞ্জনে বিদেশিদের পাশাপাশি দেশি তরুণীদেরও ব্যবহার করতেন পাপিয়া। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ক্লিপসের ভয় দেখিয়ে পরে তাদের কাছে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হতো। সম্মানের হারানোর ভয়ে ওইসব ব্যক্তি পাপিয়া ও সুমনের কথার বাইরে যেতে পারতেন না।’ পুলিশ ও র্যাবের দুই কর্মকর্তা বলেন, ‘পাপিয়া ও সুমনের মোবাইল ফোনে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির মোবাইল নাম্বার সেভ করা। ওই ব্যক্তিদের সঙ্গেও তাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। গ্রেপ্তারের দিন পাপিয়া র্যাব কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকিও দিয়েছেন। এমনকি ধরার পরিণাম ভালো হবে না বলে হুঁশিয়ারিও দেন। ওই সময় মোবাইল ফোনে কয়েকজনের সঙ্গের কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাননি। পরে পাপিয়াসহ চারজনের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। এতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তাদের ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।’ সূত্র: দেশ রূপান্তর