একরাতে ২০ হাজার ডলার, পরদিন ভাতও জোটেনি প্রবাসীর !!
প্রায়ই শুনি আলী ভাই ফোরডি পেয়েছেন। সালাম ভাই হঠাৎ কোটিপতি বনে গেছেন। কেউ কেউ আবার দামি গাড়িতে চড়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছেন। শুনি আর জ্বলেপুড়ে মরি। মাঝে মাঝে ভাবি সিঙ্গাপুরে এসে কলুর বলদের মতো কাজ করেই গেলাম, উপভোগ করতে পারলাম না।
ফোরডি বিনা পরিশ্রমে টাকা আয়ের সহজ রাস্তা। অথচ আজও আমি ফোরডি খেলিনি। বিকেলে ফোরডি শপে গেলে দেখা যায় বয়স্ক ও তরুণদের লম্বা লাইন। এলাকাটি সবসময় জমজমাট থাকে। অনেক প্রবাসী জুয়ার ফাঁদে একদম পথে বসে গেছে বলেও জেনেছি।
সিঙ্গাপুরে অনেক ধরনের জুয়া রয়েছে- ফোরডি: ফোরডি হলো চার ডিজিট নম্বর। চারটি নম্বরে কাটা হয় এবং প্রতি শনি, রবি আর বুধবারে এর ড্র অনুষ্ঠিত হয়। টাকার উপর নির্ভর করে প্রাইজমানি।
টোটো: টোটো হলো অনেকগুলো নম্বরের সমষ্টি। এটাকে বলা হয় নম্বরের খেলা। সিস্টেম ৭ নম্বরে ৭ ডলার। সিস্টেম ৮ নম্বরে ২৮ ডলার। সিস্টেম ৯ নম্বরে ৮২ ডলার। সিস্টেম ১০ নম্বরে ৩৮২ ডলার। সিস্টেম ১১ নম্বরে ৪৬২ ডলার। সিস্টেম ১২ নম্বরে ৯২৮ ডলার পে করতে হয়।
কমপক্ষে তিন নম্বর মিলে গেলেই প্রাইজমানি পাওয়া যায়। আর ৬ নম্বর মিলে গেলেই প্রথম পুরস্কার ১ মিলিয়ন ডলার। সপ্তাহে দুই দিন এর ড্র অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার ও বৃহস্পতিবার। সোমবারে ড্র’তে যদি কেউ প্রথম পুরস্কার না পায়, তাহলে বৃহস্পতিবার প্রথম পুরস্কার হবে দুই মিলিয়ন।
আর বৃহস্পতিবার যদি কেউ প্রথম পুরস্কার না পায়, তাহলে পরের সোমবার প্রথম পুরস্কার হবে ৪ মিলিয়ন। এভাবে সর্বোচ্চ ৮ মিলিয়ন পর্যন্ত যাওয়া হয়। যদি ৮ মিলিয়নও কেউ না পায়, তাহলে এই আট মিলিয়ন সবার মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়।
বিগ সুইফ : মাসে ২.২ মিলিয়ন ডলারের লটারি হয়। কেউ একবার পেয়ে গেলে কয়েক বছর তাকে কাজ করতে হবে না। যদি লাইগা যায়। এটা বাংলাদেশের লটারির মতোই।
খেলা : বিভিন্ন খেলার মধ্যে ফুটবলের উপর জুয়া হয় বেশি দেশটিতে। আর প্রতিদিন ফুটবলের উপর বাজি তো আছেই। আর ঘোড়া দৌড়ের উপরও খেলা হয় হাজার হাজার ডলারের জুয়া।
সবচেয়ে ভয়াবহ জুয়া হলো ক্যাসিনো। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুয়ার আসর বসে এই ক্যাসিনোতে। এখানে কেউ এক রাতে কোটিপতি হয় কেউবা জিরো। আমার এক বন্ধু প্রায় ক্যাসিনোতে যায়। একদিন বিশ হাজার ডলার জিতে আমাকে ফোন দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে বলল।
বিপদে পড়েছে মনে করে আমি গেলাম। সেখানে গেলে, আমার ট্যাক্সি ভাড়া সেই দেই। তারপর ব্যয়বহুল হোটেলে নিয়ে বসায়। তার ভাবসাব দেখে বুঝে ফেলি তার কাছে এই মুহূর্তে অনেক টাকা তাই আমি কিছু না বলে তাকে ফলো করে গেলাম। এরপর দামি খাবারের পাশাপাশি হুইস্কি নিয়ে বসল।
তিনি হুইস্কি খায় আর আমি বসে বসে মজা নিউ। নেশাগ্রস্ত মানুষের পাশাপাশি থাকলে একধরনের আনন্দানুভূতি হয় আমার। তখন তাদের মনের দরজা খুলে যায়। যা বলে মন থেকেই বলে। যখন সে সম্পূর্ণ নেশাগ্রস্ত হয় তখন তার মনের কথা, তার স্বপ্নের কথা বলে থাকে। তারপর তাকে ধরে রুমে পৌঁছে দিলেই আমার কাজ শেষ।
তাকে বলেছিলাম যা জিতেছেন তা বাড়িতে পাঠিয়ে দিন, নিজের কাছে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি আমার কথা শুনলেন না। তার ফলাফল তার পরদিন রাতে কল দিয়ে আমাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলল, বিশ ডলার নিয়ে হাউজের নিচে দাঁড়ান আমার কাছে কার ভাড়া দেবার মতো কোনো টাকা নেই। সেদিন আমি ভাড়া দিয়ে সাহায্য করেছিলাম।
কিছুদিন পর শুনলাম সে কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খেয়েছিল কয়েকদিন। একটা সময় নিয়মিত ভাতও জুটতো না তার। এক রাতে সর্বোচ্চ খুইয়ে এমনকি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। এরপর থেকে তার সাথে আর সম্পর্ক রাখিনি।
আসল কথায় আশা যাক, কয়েকদিন পরপর ফোরডি পাওয়ার কারণে আলী ভাইয়ের নাম হয়ে গেছে ফোরডি আলী। এখন তাকে সবাই ফোরডি আলী নামেই চেনে।
লোকজনের মুখে শুনতে শুনতে আমারও ফোরডির প্রতি তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আমরা মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী। খারাপ জিনিসের কথা বারবার শুনতে শুনতে সেই খারাপ জিনিসের প্রতি তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
তাই আমি লোভের কাছে বশীভূত হয়ে গেলাম। লোকের মুখে ফোরডি আলী ভাইয়ের নাম শুনতে শুনতে আমারও ফোরডি খেলে বড়লোক হবার প্রবল ইচ্ছা হলো। যে কথা সেই কাজ, একদিন আমি ফোরডি, টোটো, বিগ সুইফ মিলিয়ে তিনশ ডলার খরচ করলাম। যদি লাইগা যায়, তাহলে আর প্রবাসে থাকতে হবে না। এক দানে কোটিপতি।
কিন্তু হায়! রেজাল্ট পেলাম আমার তিনশ ডলারই পানিতে গেল। রাগে-ক্ষোভে ফোরডি আলী ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, এই মিয়া আপনি ফোরডি পান তা আবার সবার কাছে বলে বেড়ানোর দরকার কি? আর আপনি এত ঘনঘন ফোরডি পেলে সিঙ্গাপুরে কি করছেন? ফোরডি আলী ভাই তার সাদা ঝকঝকে দাঁত দুটি বের করে বলল, আপনি এত উত্তেজিত কেন? কি হইছে ঠান্ডা মাথায় খুলে বলুন।
আমি জবাব দিলাম, আপনি ঘনঘন ফোরডি পান তা শুনে আমিও লোভে পড়ে তিনশ ডলার খরচ করে ফোরডি টোটো কেটেছিলাম কিন্তু এক টাকাও পাইনি। আপনার জন্যই আমি আজ এতগুলো ডলার খুয়ালাম। আপনি যদি সবার কাছে বলে না বেড়াতেন তাহলে আমার আর জুয়া খেলার লোভ হত না। আলী ভাই এবারও সহজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিল, তাহলে শোনেন ভাই আমি কোনো ফোরডি পাইনি।
জীবনে একবার পেয়েছিলাম ২০ হাজার ডলার কিন্তু কিছু লোক সেই পাওয়াটাকে কয়েকদিন পরপর পাওয়ায় পরিণত করেছে। আপনিই বলুন যদি কয়েকদিন পরপর ফোরডি পেতাম তাহলে কি আমি এখানে পড়ে আছি। আর জুয়া খেলে আজ পর্যন্ত কেউ লাভের মধ্যে নেই। বছর শেষে হিসেব করলে দেখা যায় যত জিতেছে তার চেয়ে বেশি হেরেছে।
তার কথা শুনে আমি শান্তভাবে ভাবতে লাগলাম, ঠিকই তো কিছু লোক আলী ভাই ফোরডি পেয়েছে এই কথা প্রচার করে, লোকদেরকে ফোরডির প্রতি লোভ যোগাচ্ছে আর আমার মতো বোকারা প্রতিনিয়ত এই লোভে পড়ে কষ্টার্জিত টাকা জুয়া খেলে নষ্ট করছে। আলী ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তওবা করলাম, এই জীবনে আর বিনা পরিশ্রমে সম্পদশালী হতে যাব না। নিজে পরিশ্রম করে চারটা ডাল-ভাত খেয়ে নাকে সরিষার তেল দিয়ে শান্তির ঘুম দেব।
বিঃ দ্রঃ সিঙ্গাপুর সরকার, জনশক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে বারবার ডরমিটরিগুলোতে জুয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কিত প্রচারণা করা হয়। কাউন্সিলর দ্বারা জুয়ায় আক্রান্তদের নিয়ে পরামর্শসভা করানো হয়। তবুও জুয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে না বরং দিনের পর দিন বাড়ছে। কারণ একটাই, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ সেই আদিকাল থেকেই।