এবারও রাস্তায় ফেলে দিতে হবে পেয়াঁজ, জেনে নিন কেন??
বর্তমানে আমদানি করার পরও পেয়াঁজের বাজার লাগামহীন কিন্তু দেশের কৃষকরা যখন সিজনাল পেয়াঁজ তুলবেন তখন কি ন্যায্য মূল্য পাবেন। গতবরের মত এবারও পেঁয়াজ নিয়ে শঙ্কা কাটছে না কৃষকদের। যে পরিমাণ পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আসতে শুরু করেছে তাতে শেষ পযন্ত কৃষকদের পেয়াজ গতবারের মত রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ কারা লাগতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে কৃষকরা।
২০১৭ সালে কৃষক পেঁয়াজ চাষ করে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পর ২০১৮ সালের মৌসুমের শুরুর দিকে অল্প কিছু চাষী লাভের মুখ দেখলেও ভরা মৌসুমে পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হয় চাষীরা। চলতি বছরও পেঁয়াজ চাষে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষীরা। তবে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়াতে ১৮ জেলায় ৭ হাজার ৭০০ কৃষককে সরকার বীজ ও সার দিবে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা কাটিয়ে উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরেই প্রথম পেঁয়াজ চাষের জন্য চাষীদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ফরিদপুর, রংপুর, জামালপুর, মাগুরা ও বরিশালসহ ১৮টি জেলার ৭ হাজার ৭০০ কৃষক এক কেজি পেঁয়াজ বীজ এবং ৩০ কেজি সার উভয় বিনামূল্যে পাবেন। এক কোটি ৩২ লাখ টাকার বীজ ও সার বিতরণ করা হবে। বিতরণ ব্যয়সহ কৃষকদের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (ফিল্ড সার্ভিস উইং) চন্ডী দাস কুন্ডু জানান, পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতেই এবারই প্রথম প্রতিজন কৃষককে এক বিঘা করে জমি চাষের জন্য প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ১৮টি জেলার ৭ হাজার ৭০০ জনকে কষককে প্রণোদনা পাবেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকেই এইসব পেঁয়াজ তোলার সময় হবে। প্রণোদনার ফলে দেশে অতিরিক্ত ১১ হাজার ৫৩২টন পেঁয়াজ অতিরিক্ত উৎপাদন হবে। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, পেঁয়াজ সাধারণত সারা বছরই উৎপাদিত হয়। চলতি বছরই প্রথম পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। দেশীয় উৎপাদন এবং নির্ভশীলতা বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় এবারই প্রথম গম, ভুট্টা, সরিষা, চীনাবাদাম, মুগডাল এবং সূর্যমুখীর পাশাপাশি পেঁয়াজ চাষের জন্য প্রণোদনা চালু করেছে।
জানা গেছে, ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার পেঁয়াজের দেশীয় প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। এরপরই দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিক বাড়তে শুরু করে। এদিকে ফরিদপুর সদরের চরমাধব দিয়া ইউনিয়নের মহিউদ্দিন মৃধার ডাঙ্গির চাষি মুবিন মীর মালুত জানান, চলতি বছর তিনি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগিয়েছেন। এক বিঘা জমিতে গুটি পেঁয়াজ লেগেছে ১০ মণ। একটু আগেভাগে গুটি কিনে রাখায় তিনি ৩ হাজার ৫০ টাকা করে কিনতে পেরেছিলেন। জমি চাষ করেছেন ২ হাজার টাকায়। ৯ জন শ্রমিককে দিতে হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। সার লেগেছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া পানি দিতে খরচ হবে ৮০০ টাকা, নিড়ানিতে ৪ হাজার টাকা, পেঁয়াজ উত্তোলনে খরচ হবে ২ হাজার টাকা, কাটায় খরচ হবে ২ হাজার টাকা এবং পরিবহনে খরচ হবে আরও ৩ হাজার টাকা। জমির ভাড়া এবং নিজের পরিশ্রম বাদেই তার খরচ হবে ৫১ হাজার ৩০০ টাকা।
ফলন যদি ভালো হয় এবং ২ হাজার টাকা মণের কাছাকাছি দামে বিক্রি করতে পারলে তিনি আসল তুলতে পারবেন। ২০১৮ সালে তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগিয়েছিলেন। তাতে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা বিঘায় খরচ হলেও তিনি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে সাড়ে চার বিঘা পেঁয়াজ চাষ করে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন। চলতি বছরও পেঁয়াজের দাম নিয়ে তিনি শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। কারণ প্রতি বছর ভরা মৌসুমে পেঁয়াজের দাম অনেক কমে যায়। ফলে চাষিরা ক্ষতির সম্মুখীন হন।
প্রায় একই রকম কথা বলেছেন জেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের চাষি আলমাস শেখ। তিনি বলেন, গেল বছর তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। চলতি বছর তিনি দেড় বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। গত বছর গুটি কিনেছিলেন ১ হাজার ২০০ টাকায়। চলতি বছর একই গুটি কিনেছেন ৪ হাজার ২০০ টাকায়। গত বছর ২০ থেকে ২২ হাজার টাকায় এক বিঘায় পেঁয়াজ উৎপাদন করেও তিনি লোকসানে ছিলেন। চলতি বছর দেড় বিঘায় প্রায় ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই তিনি পেঁয়াজের চাষ কমিয়েছেন।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর ৩৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। গত বছর ফরিদপুরে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে ফরিদপুর সদর উপজেলায় ২ হাজার ২০ একর জমিতে। আর সদরপুর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। চলতি বছরে মুড়িাকাটা পেঁয়াজের বপন অর্ধেকে নেমে গেলেও কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত বছরের প্রায় সমান পেঁয়াজ বপন করা হয়েছে। আবাদের পরিমাণ প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, ভরা মৌসুমে সাধারণত পেঁয়াজের দাম কমে যায়। এসময় পেঁয়াজ কিছুটা পরিপক্ক করে উত্তোলন করে কয়েক মাস রেখে দিলে দাম ভালো পেতে পারে। তবে কৃষকরা বলছেন, তারা মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে, গৃহিণীর অলঙ্কার বিক্রি করে কিংবা এনজিও থেকে লোন নিয়ে পেঁয়াজের আবাদ করেন। তাদের পক্ষে পেঁয়াজ মজুদ করে রাখা সম্ভব হয় না। ফরিদপুর সদরের সিয়াম জুয়েলার্সের মালিক সিদ্দিকুর রহমান জানান, পেঁয়াজ আবাদের সময় কৃষকদের স্বর্ণ এবং রুপার অলংকার বিক্রির হার বেড়ে যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যারা গৃহিণীর স্বর্ণের অলংকার বিক্রি করে পেঁয়াজের আবাদ করেন প্রায় প্রতি বছরই কৃষকরা লোকসান দেওয়ায় তারা আর নতুন গহনা গৃহিণীকে তৈরি করে দিতে পারেন না।