পতিতালয়ে যাচ্ছে শিশু খদ্দের – শিশুরা হারাচ্ছে উজ্জ্বল ভবিষৎ !!
ময়মনসিংহ শহরের পতিতালয়ে পতিতাবৃত্তিতে শিশুরা নিয়োজিত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপরদিকে খদ্দের হয়ে পতিতালয়ে প্রবেশ করে হারাচ্ছে উজ্জ্বল ভবিষৎ শিশুরা। এক শ্রেণীর দালাল পারিবারিক আর্থিক দৈন্যতার সুযোগ নিয়ে অথবা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কৌশলে পতিতালয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন এসব মেয়ে শিশুদের। সামাজিক ঘৃণা বা লোক লজ্জ্বার ভয়ে পতিতাবৃত্তিতে জড়িত শিশুরা প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। এই শিশুদের এখান থেকে উদ্ধার এবং সমাজের চক্ষুসূল থেকে পরিত্রাণের দাবী করেছেন বিভিন্ন সামজিক সংগঠন।
জানা যায়, সংবিধানের ১৮নং অনুচ্ছেদের ২নং উপ-অনুচ্ছেদ অঙ্গীকার করা হয়েছে যে, রাষ্ট্র পতিতাবৃত্তি নিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ৪০নং অনুচ্ছেদ মতে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে কোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের দ্বারা কোনো যোগ্যতা নির্ধারণ হয়ে থাকলে অনুরূপ যোগ্যতা সম্মান প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো আইন সংক্রানমশপেশা বা বৃত্তি গ্রহণের অধিকার থাকবে। উপরে উল্লিখিত সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদ মতে, পতিতাবৃত্তি একদিকে রাষ্ট্র, নিরোধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং এটি একটি অনৈতিক পেশা ও বৃত্তি।
রাষ্ট্র যেখানে এটা নিরোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করেছে সে ক্ষেত্রে কোনো নারী বা মেয়ে পতিতাবৃত্তি করার জন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সমানে হলফনামা সম্পাদন করতে পারে না । তবে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বাংলাপিডিয়ার মধ্যে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্র গণিকালয় পতিতাদের যৌনকর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব বসতিস্থল সাধারণত এটি পাড়া বা বেশ্যাপাড়া নামে সুপরিচিত। পতিতারা তাদের বৃত্তির জন্য হলফনামা দিয়ে অনুমতি গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য, হলফনামায় ঘোষণা করতে হবে, তার ভরণপোষণের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এবং তাকে সাহায্য করার কেউ না থাকায় সে স্বেচ্ছায়, অন্যের বিনা প্ররোচনায় ওই পেশা বেছে নিয়েছে এবং এ পেশা নির্বাচনে কোনো মহল থেকে তার ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার বা চাপ সৃষ্টি করা হয়নি।
মেয়ে শিশু ও নারীদের পতিতাবৃত্তি থেকে বাঁচানোর জন্য আইন রয়েছে, পাশাপাশি যারা পাচারের মাধ্যমে মেয়ে শিশুদের বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করে তাদের শাস্তি প্রদানের জন্য ব্যবস্থাও বিদ্যমান। নিম্নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আইনসমূহের সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদ ১৮ (২) মতে, পতিতাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ (১৮৬০ সালের ৪৫নং আইন)-এর ধারা : ৩৬৬, ৩৭২, ২৬৬, ৩৭৩-এ অপরাধীদের শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। কোনো মেয়েকে বিয়ে ইত্যাদিতে বাধ্য করার জন্য অপহরণ করলে (৩৬৬-ক) বা বেশ্যাবৃত্তির জন্য অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েদের বিক্রয় বা ভাড়া দেয়ার জন্য (৩৭২) বা বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদির অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েদের ক্রয়ের জন্য (৩৭৩) শাস্তির যে কোনো বর্ণনার কারাদন্ড যার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে, তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (২০০০ সালের ৮নং আইন) এর ধারা : ৫, ৬, ৭ এর জন্য যথাক্রমে পতিতাবৃত্তি বেআইনি বা নীতিবিগর্হিত কোনো কাজে নিয়োজিত করার জন্য কোনো মেয়েকে বিদেশে পাচার বা বিদেশ থেকে আনা বা পতিতালয়ে ক্রয়, বিক্রয়, হস্তান্তর, ভাড়ায় বা দখলে রাখার অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড- বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডে বিধান এই ধারায় রয়েছে। সর্বোচ্চ ২০ বছর ও সর্বনিম্ন ১০ বছর কারাদন্ড বিদ্যমান রয়েছে। শিশু অধিকার আইন ১৯৭৪-এর ১৭ ধারায় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতে শিশু অধিকার সনদ ১৯৮১ এবং অনুচ্ছেদ ১৯, ৩৪ এ মেয়েশিশুদের সুরকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
আইনে উল্লেখ রয়েছে, ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের বালিকাদের যদি পতিতালয়ে পতিতাবৃত্তির জন্য রাখা হয় তাহলে সেটাও আইন মতে উল্লেখযোগ্য অপরাধ। শিশু অধিকার সনদের ৩৪ ধারায় সরকারসমূহকে পতিতালয় মেয়ে শিশুদের শোষণমূলক ব্যবহার যা অন্যান্য বেআইনি যৌনাচারের অবসান সুনির্দিষ্টভাবে অনুমোদন করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে বিদেশি সফরকারী ব্যবসায়ী পর্যটকদের দ্বারা শিশুদের যৌন অব্যবহার সম্পর্কে সংবাদ পাওয়া গেছে। জার্মানি, নরওয়ে ও সুইডেনে শিশুর অব্যবহারমূলক ‘যৌন পর্যটকদের’ নিজ দেশে আদালতে সোপর্দ করার বিধান সংবলিত আইন প্রবর্তন করেছে। ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ডে এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন বিবেচনায় রয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে বিষয়টি এখনো অপ্রাসঙ্গিক হিসেবেই রয়ে গেছে। যদিও এদেশে বিদেশি পর্যটকদের দ্বারা মেয়ে শিশুরা যৌন অব্যবহারের শিকার তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইউসিপি এটি নিউজলেটার বিশেষ সংখ্যা জুলাই ১৯৯৩ এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্যাথলিক চাইল্ড ব্যুরো অপ্রকাশিত উপাত্ত ১৯৯৪ এর ‘হাউমেনি চিলড্রেন আর ইন প্রপাটিটিউশন ইন এশিয়া?’ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের মধ্যে অসম সম্পর্ক যা মেয়েদের অধঃস্তন করেছে। পাশাপাশি, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পরিবার কাঠামো এবং বিরাজমান বৈষম্য, পুরুষ তান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মধ্যযুগীয় সমাজতান্ত্রিক প্রথা মুল্যবোধের প্রভাব, যা মেয়েদের পণ্য হিসেবে বিবেচিত করেন এসবের নির্মূল করা। পরিবারের অভ্যন্তরে মেয়েদের ক্ষমতায়িত করা এবং শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা যার ফলে সম্পদ ও সম্পত্তিতে মেয়েদের সমঅধিকার নিশ্চিত করা। এছাড়াও মেয়েদের কর্মসংস্থানের বিস্তৃত পরিবর্তন করা। কেননা মেয়েরা প্রায়ই ভালো কাজের লোভে পাচারকারীর পাল্লায় পড়ে বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। পরিবারের অভ্যন্তরে ছেলেমেয়ে শিশুদের মধ্যে সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যেসব পরিবারে মা মারা গেছে বাবা নতুন বিয়ে করেছে কিংবা বাবা-মা বিচ্ছেদ গ্রহণ করেছে সেসব মেয়ের পরিবারের অন্য অভিভাবকদের খেয়াল রাখা দরকার। তাদের সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। মেয়েদের প্রতি প্রচলিত বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মূল্যবোধ ও সামাজিক প্রথার আমূল পরিবর্তন করা দরকার।
মানবতা ও সমতার নীতিতে নতুন মানবিক ও সমতাপূর্ণ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। মেয়েবান্ধব আইনের প্রচলন করতে হবে, যেখানে মেয়েদের স্বার্থ প্রধান্য পাবে। প্রদচলিত বৈষম্যমূলক আইনের সংস্কার করতে হবে। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জেন্ডার সংবেদনশীল ও পতিতাবৃত্তি নির্মূলের আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। মেয়েদের তথা নারীদের ভোগ্যপণ্য ভাবা যাবে না। দেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেককে বিশেষ করে তরণ সমাজকে মেয়ে শিশুদের দিয়ে বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ১৮৬০ সালে অর্থাৎ প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো দন্ড-বিধি বাতিল ঘোষণা করে নতুন সময়োপযোগী নারীবান্ধব দ-বিধি প্রণয়ন করতে হবে। মেয়ে শিশুদের দিয়ে পতিতাবৃত্তিসহ সব ধরনের অপরাধের বিধান সংক্ষিপ্ত নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থিত জাতিসংঘ সংস্থাসমূহ বিশেষ করে ইউনিসেফ ও আইএলওকে কাজে লাগাতে হবে। মানবাধিকার কর্মী, পুলিশবাহিনী, সাংসদ, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের এ ব্যাপাারে কাজে লাগাতে হবে। এছাড়াও . সারাদেশে কাজে লাগাতে হবে।
জেলা প্রশাসনকে জেন্ডার মেনমিটাইজড করার পাশাপাশি প্রতিটি জেলা পর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাকশন কমিটি গঠন করতে হবে। মেয়ে শিশুদের বাধ্যতামূলক পতিতা বৃত্তি বন্ধের জন্য গড়তে হবে। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজের সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। শিশু অধিকার ক্ষেত্রে ভয়াবহ দিক হলো এর প্রয়োগ অর্থাৎ শিশু অধিকার সনদের আইনগত বলবৎ করতে না পারা। বিদ্যমান আইন কাঠামো শিশু অধিকারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক নয়। এতে বিস্তারিত ভাবে দেখানো হয়েছে বিদ্যমান আইন বিচার ব্যবস্থা কত বেশি অপর্যাপ্ত। বর্তমান সরকারের উচিত হবে নারী শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সাধানের মধ্য দিয়ে উল্লেখিত বিষয়সমূহ ক্ষতিয়ে দেখা। পাশাপাশি শিশু অধিকার সনদের প্রচলিত আইন কাঠামোর সঙ্গে যে দন্ধ তা নিরসনে জোর প্রদান করা। পাশাপাশি ইউনিসেফসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ বাণিজ্যিক শোষণ নিপীড়ন প্রতিরোধে সচেষ্ট; কিন্তু সর্বোপরিভাবে মেয়ে শিশুদের সামাজিক শোষণ নিপীড়নের প্রতি কঠোর মনোযোগ দেয়া হয় না। বিষয়টি গবেষণার দাবিদার। শিশু পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশে একটি নিদারুণ বাস্তবতা। পাচার হয়ে যাওয়া মেয়ে শিশুদের পাশাপাশি পতিতালয়ে জন্মগ্রহণ করা পতিতাদের কন্যা সন্তানরাও ভবিষ্যতে পতিতাবৃত্তির জন্য বেড়ে ওঠতে থাকে। পতিতাবৃত্তির বিষয়ে বাংলাদেশ সংবিধানে বৈরি ভাব সুস্পষ্ট।
আমাদের দেশে পতিতাদের স্বীকৃতি তো দূরের কথা বরং তাদের এ পেশাই সমাজের চোখে মারাতক ঘৃণ্য বলে বিবেচিত। কোনো পতিতার মৃত্যুতে শুধু তার সহকর্মীরাই তার দেহ স্পর্শ করতে পারবে, তাকে কোনো সাধারণ সর্বনজনীন গোরস্থানে দাফন করা যাবে না, এ সব বিধি-নিষেধ থাকার পরও নিরক্ষরতা, দ্রারিদ্য, বেকারত্ব ও পারিবারিক বিপর্যয় ইত্যাদি কারণে উদ্বেগজনকভাবে প্রতিনিয়ত শিশু পতিতাদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। অপরদিকে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের এক গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, অল্প বয়সী ছেলেরা বেশি পতিতালয়ে যাচ্ছে। পতিতালয়ের ৪৩ শতাংশ নারী এই পেশায় নিয়োজিত হওয়ার আগে যৌন হয়রানির শিকার হয়। আর যৌন হয়রানির শিকার ৪৯ শতাংশই হচ্ছে শিশু। সূত্রের দাবী, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের পর বেশি নজর দেওয়া হয়ে থাকে পরিবারের প্রতি। অথচ শিশু বা নারীকে তার বেদনা লাঘবে সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে বিষয়টি গোপন রাখতে বলা হয়। নির্যাতনের বিষয়টি যর্থাথভাবে বিবেচিত হয়না। জরিপে কিশোরীদের যৌন হয়রানির ভীতিকর দিক তুলে ধরে বলা হয়, পতিতালয়ে শিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের মূলে রয়েছে বৈষম্যমূলক সামাজিক ব্যবস্থা।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেকোনো মূল্যে শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এজন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। নির্যাতনের শিকার শিশুরা যাতে বিচার পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুকে সহায়তা দিতে ভিকটিম সার্পোট সেন্টার চালু করতে হবে। সমাজ ব্যবস্থার কারণে নির্যাতনের শিকার শিশু ও নারীরা আরও হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। শিশু নির্যাতন বন্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের তাৎক্ষণিক যত্ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভুক্তভোগীদের সার্বিক সহায়তা দিতে হবে যাতে তারা সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
সূত্রঃ বিডি২৪ লাইভ