প্রাণে বাঁচতে দিল্লি ছেড়ে পালাচ্ছেন মুসলিমরা !!
খাজুরি খাসের চার নম্বর গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন ৬৫ বছর বয়সী মহম্মদ তাহির। কাঁদছিলেন পাশে দাঁড়ানো তাঁর দুই পুত্রবধূও। গলির মুখ থেকে তাঁদের বাড়িটা ছিল খান চার-পাঁচেক বাড়ির পরেই। হ্যাঁ, ছিল। এখন গোটা বাড়িটাই ছাই হয়ে গিয়েছে।গত মঙ্গলবার গভীর রাতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে দিতে হাজারখানেক যুবক ঢুকেছিল তাহিরদের গলিতে। তাদের হাতে ছিল ব’ন্দু’ক, ধা’রা’লো অ’স্ত্র’শ’স্ত্র। গলিতে ঢুকেই তারা মা’রধ’র শুরু করল সেখানকার বাসিন্দাদের।
ঘরে ঘরে ঢুকে শুরু করল লু’ট’পা’ট। তারপর একটা একটা করে বাড়িতে আ’গু’ন লাগাতে থাকল। লোকজন যে বাড়িগুলির ভিতরে রয়েছেন, তার পরোয়াই করল না।বাড়ি দাউদাউ করে জ্ব’ল’ছে দেখে প্রাণে বাঁচতে আর কয়েক জন পড়শির মতো তাহিরও তাঁর পরিবারের লোকজনকে নিয়ে উঠে যান ছাদে। তার পর এক এক করে সেই ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে ঝাঁপ দেন।
সেই বাড়ির ছাদ থেকে তার পরের বাড়ির ছাদে। এই ভাবে ছাদ টপকে টপকে তাহির পৌঁছে যান গলির শেষ প্রান্তে। যেখানে তখনও পৌঁছয়নি হা’না’দা’ররা।
পা’লি’য়ে প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন তাহিররা। কিন্তু বাড়ির মোহ আর ছাড়তে পারেন কী ভাবে? অনেক কষ্টে যে বানিয়েছিলেন বাড়িটা। তাই বুধবার বিকেলে দুই পুত্রবধূকে নিয়ে বাড়িটা দেখতে এসেছিলেন তাহির।
গিয়ে দেখেন, গোটা বাড়িটাই ছাই হয়ে রয়েছে। পাশের বাড়িটারও একই দশা। তার পরেরটাও…। সেটা দেখার পর আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেননি তাঁরা। গলির মুখে এসে কাঁদতে কাঁদতে বার বার পিছনে ফিরে ছাই হয়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। দুই পুত্রবধূকে নিয়ে চার নম্বর গলির মুখেই বসে পড়েছিলেন তাহির।
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাহির বললেন, ‘ওরা বাড়িতে আ’গু’ন লাগিয়ে দিল। আমরা পড়িমড়ি করে বাড়ি ছেড়ে পা’লা’তে শুরু করলাম। কোমর থেকে পঙ্গু আমার বউ। ও পারল না।আমার দুই ছেলেও গুরুতর জখম হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কিছুই আমরা দাঁতে কাটিনি। আমার সদ্যোজাত নাতিনাতনিরা জল খেয়ে রয়েছে।’
এটা ঠিকই, গলির কিছু হিন্দু বাসিন্দারও ঘরবাড়ি পু’ড়েছে। কিন্তু খাজুরি খাসের চার নম্বর গলিতে যত মুসলিম পরিবার থাকতেন, মঙ্গলবার গভীর রাতের ভ’য়া’বহ ঘটনার পর তাঁরা সকলেই সেখান থেকে অন্যত্র পা’লি’য়ে গিয়েছেন। একই চেহারা মৌজপুর বাবরপুর ও ভাগীরথী বিহারের গলিগুলির। কোনও মুসলিম পরিবার আর সেখানে নেই।
এই কাহিনী শুধু খাজুরি খাসের নয়। মৌজপুর বাবরপুর, ভাগীরথী বিহার, সর্বত্রই ছবিটা এক। গাড়ি নিয়ে সব্জি বেচেন বছরকুড়ির মহম্মদ এফাজ, খাজুরি খাসের চার নম্বর গলির মুখে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এমন ভ’য়া’বহ ঘটনা এর আগে দেখিনি।
ওদের সকলের হাতে ছিল ব’ন্দু’ক, লা’ঠি, ধা’রা’লো অ’স্ত্র’শস্ত্র’। ওরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিচ্ছিল। ওই ধ্বনি দিতে দিতেই গলির একের পর এক ঘরবাড়িতে ওরা আ’গু’ন লাগাতে শুরু করল। গু’লি চালাচ্ছিল এলো’পাথাড়ি।’
তাঁর আড়াই মাসের মেয়েকে লক্ষ্য করেও দু’ষ্কৃ’তীরা ইট, পা’থর ছুড়েছিল, জানালেন খাজুরি খাসের আর এক বাসিন্দা সিতারা। সিতারা বললেন, ‘ওই সময় নিজেকে দিয়ে আমার বাচ্চাটাকে আড়াল করেছিলাম। বাঁচিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এখন ভাবছি, ওকে কী খাওয়াব, পরাব?’
খাজুরি খাসের চার নম্বর গলির হিন্দু বাসিন্দারা কিন্তু ওই সময় তাঁদের মুসলিম পড়শিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। মুসলিমদের ঘরবাড়িগুলি যখন পুড়ছে, তখন তাঁরা নিজেদের বাড়ি থেকে বালতির পর বালতি জল ঢেলে আ’গু’ন নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন।
পারেননি, জানালেন চার নম্বর গলির এক হিন্দু বাসিন্দা। যিনি কিছুতেই তাঁর নাম জানাতে চাইলেন না। ভ’য়ে, যদি এর পর তাঁর উপরেও চড়াও হয় দু’ষ্কৃ’তীরা।গলিতেই থাকতেন দিনমজুর মহম্মদ আরিফ। বিজয় পার্ক এলাকায় দিনদুয়েক আগে একটি কাজ পেয়েছিলেন আরিফ। জানালেন, এই ঘটনার পর তিনি প্রাণে বাঁচতে সম্ভলে চলে যাচ্ছেন। সব কিছু ছেড়েছুড়ে।
গলিতে গলিতে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, গত রবিবার থেকে টানা হিং’সা’র ঘটনার পর খাজুরি খাস, মৌজপুর বাবরপুর, ভাগীরথী বিহারের মুসলিম এলাকাগুলি খাঁ খাঁ করছে।বাড়িগুলি ছাই, তাই আক্ষরিক অর্থেই, শ্মশানের চেহারা নিয়েছে এলাকাগুলি।