বাংলাদেশে প্রবেশে ভারতীয় সীমান্তে অপেক্ষায় অসংখ্য নারী-পুরুষ !!
সম্প্রতি ভারত সরকার সেদেশের আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) প্রকাশ করে। সেখানে নাম না থাকায় নির্যাতনের ভয়ে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে অনেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বলে জানিয়েছে বিজিবি ও জেলা প্রশাসন। তবে এসব অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি করছে বিজিবি।
অপরদিকে, আটকরা জানিয়েছেন সীমান্তের ওপারে অপেক্ষমাণ আরও অসংখ্য নারী-পুরুষ। তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। অন্যদিকে, গত দুই সপ্তাহে এ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার সময় ২১৪ জনকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর মধ্যে গত দুই দিনে আটক হয়েছে ১১ জন। আটকদের মধ্যে ৫ জন পুরুষ, ৩ জন নারী ও ৩ জন শিশু।
ভারত সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো দিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মহেশপুর উপজেলা প্রশাসন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন পরিষদগুলোর (ইউপি) চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হবে। এসব কমিটি সীমান্ত এলাকায় অপরিচিত কোনো ব্যক্তি দেখলেই নিকটবর্তী বিজিবির সদস্যদের কাছে খবর পৌঁছে দেবে।
বিজিবির ভাষ্য, আটক হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। আটকরা বিজিবিকে জানিয়েছে, ভারতে জাতীয় নাগরিক তালিকার (এনআরসি) আতঙ্ক ও নানা চাপের কারণে তারা ভারত ছেড়েছেন। মহেশপুর উপজেলায় ভারতীয় সীমান্ত এলাকা রয়েছে ৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে কাঁটাতার বিহীন এলাকা রয়েছে প্রায় ১১ কিলোমিটার। কাঁটাতারবিহীন এলাকা দিয়েই বেশি অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে বিজিবি ও পুলিশ জানিয়েছে।
সীমান্তের লেবুতলা ও পলিয়ানপুর এলাকার মানুষ জানান, ভারত থেকে সবসময়ই মানুষ আসে। মাঝরাত ও সকালের দিকে বেশি লোক ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে ইছামতি নদী পার হয়ে কাঁটাতার বিহীন এলাকা দিয়ে। তবে বিকেলের দিকেও মাঝে মধ্যে লোক আসে। বিজিবি যে পাশে থাকে বিপরীত পাশ দিয়ে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে লোক ঢুকে পড়ে। ভারত থেকে এভাবে যদি লোক আসে সেটা তো আমাদের সমস্যাই।
সীমান্তের মাটিলা মসজিদের ইমাম নুরুননবী জাগো নিউজকে জানান, সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে লোক আসে ভারত থেকে। অনেক সময় তারা সীমানা ক্রস করে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কেউ ধরা পড়ে, কেউ দেশের বিভিন্নস্থানে চলে যায়। এরা মূলত এক শ্রেণির দালালদের মাধ্যমে ঢুকে পড়ছে।
বিজিবির হাতে আটক আদালতে সোপর্দ হওয়া কয়েকজন জানান, আমাদের কোনো নাগরিকত্ব ছিল না। ভারতেও গিয়েছিলাম পাসপোর্টবিহীন অবস্থায়। এখন দালাল ধরে চলে এসেছি। কারণ মালিকরা আমাদের টাকা-পয়সা দেন না।
বিজিবির হাতে আটক এক নারী জানান, মোদী যখন ঘোষণা করেছে এরা থাকবে না। এরপর থেকে আমরা যাদের বাড়িতে কাজ করতাম তাদের বাড়িতে সরকার লোক পাঠিয়েছে। সরকারের লোকজন বলেছে, দেখো তোমরা তো কাজ করো, তোমরা মুসলিম, বাংলাদেশি, তোমাদের কাজ করতে দেবে না। তাই এখন কি করা যাবে তোমরা যেখান থেকে এসেছো সেখানে চলে যাও। বাঙালি এখানে থাকবে না, তোমরা যদি আমার ধর্ম পালতে পারো তাহলে থাকতে পারো। তখন আমরা বলেছি তোমার ধর্ম পালতে পারবো না আমরা থাকবো না।
আটক আরেক নারী বলেন, আমরা যেখানে থাকি, তারা বলছে আমরা তোমাদের আর ভারতে রাখতে পারবো না। শেষে আমরা ওই দেশের দালাল ধরে এ দেশে এসেছি। এপারে আসার পরে বিজিবি আমাদের ধরে এনেছে। আমাদের কোনো পাসপোর্ট ভিসা নেই। ভারতে যাওয়ার সময় পাসপোর্ট ছাড়াই গিয়েছিলাম অনেক বছর আগে।
আটক আরও কয়েকজন জানান, আমরা চার-পাঁচ দিন ধরে অনাহারে আছি। এ দেশে আসার সময় আমরা ৫ জন এসেছি দালালের হাতে ৯০ হাজার টাকা দিয়ে।
আটক একজন পুরুষ জানান, তার বাড়ি মোংলার গোয়াড়িমার গ্রামে। তিনি তিন বছর আগে ভারতে চলে যান। ওখানে মুসলিমদের রাখবে না তাই চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।
মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) উপজেলা পরিষদের মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় অনুপ্রবেশকারীদের কথা তুলে ধরেছি। তখন বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয় সীমান্ত এলাকায় অনেক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। এজন্য চেয়ারম্যান-মেম্বরসহ গ্রামের মানুষদের একত্রিত হয়ে সীমান্তে নজর রাখার কথা বলা হয়।
তিনি জানান, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক লোক ভারতে চলে গিয়েছিল। তারা হয়তো ভারতে গিয়ে কাজ করে খেত। যারা আসছে তারা এখানে একদম নিঃস্ব অবস্থায় আসছে।
৫৮ বিজিবির মহেশপুরের জলুলী ক্যাম্পের সুবেদার মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ভারত থেকে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। এ পরিস্থিতিতে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। এ নিয়ে সভায় আলাপ-আলোচনা হয়। সবশেষে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তবর্তী ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে কমিটি গঠন করে বিজিবিকে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়।
ভারতের আসামে গত (৩১ আগস্ট) এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়। এতে ঠাঁই পাইনি ১৯ লাখের বেশি মানুষ। তালিকা প্রকাশের পর বিশাল সংখ্যক মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে গত (২৭ সেপ্টেম্বর) নিউ ইয়র্কে বৈঠকে এবং ৫ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই। সর্বশেষ গত বুধবার ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি ও দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, আসামের মতো এনআরসি সারা ভারতেই হবে।