বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে !!
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বারবার তাগাদা দেয়ার পরও সাড়া মেলেনি মিয়ানমারের। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও প্রত্যাবাসন রুখতে নানা টালবাহানা করছে দেশটি। এমন অবস্থায় সংকট নিরসনে কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আরও জোরেসোরে দেনদরবার শুরু করেছে বাংলাদেশ। এমনকি দেশটির জিএসপি সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের কাছে।
যদিও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেন, এটা নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে ঝগড়া করছি না। বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা মিয়ানমারকে সহযোগিতার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ সমস্যার আশুসমাধান হওয়া প্রয়োজন। এটা আমাদের দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এ সমস্যার গুরুত্ব বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মনগড়া তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এড়াতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করছে। বাকুতে নিরপেক্ষ আন্দোলনের (এনএএম) মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বিষয়টি উত্থাপন করে বলেন, বিশ্ব যদি রোহিঙ্গা সংকটের পুনরাবৃত্তি দেখতে না চায়, তবে যারা গণহত্যা চালিয়েছে অবশ্যই সেসব অপরাধীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
মিয়ানমারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এবং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধন অভিযানের দায়ে গত সোমবার ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসির) সদস্য গাম্বিয়া জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের মুসলিম–অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের ২৪টি সীমান্তচৌকিতে একযোগে হামলা হয়। এরপর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম–নির্যাতন শুরু হলে ২৫ আগস্ট থেকে সেখানকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে থাকে। বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। পরবর্তীতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে যায়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নতুন কৌশল প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বলেছি, আপনারা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চান। অথচ মিয়ানমারে উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জিএসপি সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন।’
‘আপনারা (ইইউ) বলুন, যতদিন রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হচ্ছে ততদিন তোমাদের (মিয়ানমার) জিএসপি সুবিধা দেব না’- যোগ করেন তিনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিরোধিতায় ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) সদস্য হতে চেয়ে পারেনি মিয়ানমার। বাংলাদেশের এ কূটনৈতিক কৌশলকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের নীরবতা ভাঙতে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আনার দাবি তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের এমন উদ্যোগ ‘ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড’। মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ প্রয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ যাতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে সে বিষয়ে বাংলাদেশকে আরও বেশি নজর দিতে হবে।’
‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়া মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাধ্য করা যাবে না। অন্যদিকে নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত না যাওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি’ মনে করেন এ কূটনীতিক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত মাসে প্রায় ১৫ দিন ইউরোপ সফর করেন। এ সময় বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্ব পায় বলে সূত্র জানায়।
দেশে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সাংবাদিকদের বলেন, ইউরোপ সফরকালে বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেছি। এ সংকট সমাধানে এবং মিয়ানমারকে চাপে রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি দেশে দেশটির জিএসপি সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করেছি।
এদিকে গত ৫-৭ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হয় ২১তম ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ) কাউন্সিল অব সিনিয়র অফিসার্স (সিএসও) সভা। আইওআরএ’র ২২ সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এবং সংলাপে অংশ নেয়া প্রতিনিধিদের বৈঠকে বাংলাদেশের বিরোধিতায় খারিজ হয় মিয়ানমারের সদস্য হওয়ার আবেদন।
বাংলাদেশ মিয়ানমারের সদস্যপদ পাওয়ার আবেদনের বিরোধিতা করে সেখানে উল্লেখ করে, দেশটির অসহযোগিতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে বিঘ্ন ঘটছে। বাংলাদেশ বলেছে, ‘মিয়ানমার একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হওয়ার বিষয়ে তার ইচ্ছা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটির আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বিধিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধার অভাব রয়েছে।’
যেহেতু, আইওআরএ সনদের মৌলিক নীতিমালার অধীনে অনুচ্ছেদ ২ (গ) অনুযায়ী, সব স্তরের সকল বিষয় ও ইস্যুতে সিদ্ধান্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেয়া হবে, তাই বাংলাদেশের বিরোধিতার কারণে মিয়ানমারের সদস্যপদ আবেদন বাতিল এবং মুলতবি করা হয়।
ওই সভায় ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ভাইস চেয়ারম্যান পদটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর থেকে দুই বছর মেয়াদে বাংলাদেশ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।