ব্যাঙ্গালোরে আটক কথিত ৫৯ বাংলাদেশীকে নিয়ে রহস্য !!
ভারতের ব্যাঙ্গালোরে আটক কথিত ৫৯ অবৈধ বাংলাদেশীকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের বেড়াজাল। কিন্তু এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিশ্চয়তা মেলে নি। কলকাতার প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। আটক ওইসব কথিত বাংলাদেশীর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছে বিবিসি। ‘৫৯ বাংলা মাইগ্রেন্টস পুশড ব্যাক: রাইটস বডি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে টাইমস অব ইন্ডিয়া বলেছে, কথিত এসব বাংলাদেশীকে পুশব্যাকের বিরোধিতা করছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস। তারাই বলছে, এরই মধ্যে ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ক এজেন্সিগুলো তাদের ‘কাজ’ শেষ করে ফেলেছে। একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে আজ ১লা ডিসেম্বরের এ রিপোর্টে বলা হয়, গত ২৪ ঘন্টায় মালদায় ভারত-বাংলাদেশী সীমান্ত দিয়ে ২২, ২০ এবং ১৭ জন করে তিনটি ব্যাচে এসব বাংলাদেশীকে পুশব্যাক করা হয়েছে।
এসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট সদস্য রণজিত সুর অভিযোগ করেছেন, যে প্রক্রিয়ায় এসব মানুষকে অবৈধ অনুপ্রবেশের সন্দেহে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়েছে তা নৈতিকতা ও আইনগত বৈধতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, কর্নাটক পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, আটক ওই ৫৯ জন বন্দির বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে চিঠি লেখা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ স্বরাষ্ট্র সচিবকে। যেহেতু বন্দিরা দাবি করেছে যে, তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে, তাই এটা হলো ‘লেইড-ডাউন প্রোটোকল’। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানবপাচার বিরোধী ইউনিট আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কারণ, এর সঙ্গে অনেকগুলো রাজ্য জড়িত।স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছেন, আটক বন্দিদের হাওড়ায় দুটি নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছিল এক সপ্তাহ। এরপর তাদেরকে সড়কপথে নিয়ে যাওয়া হয় মালদা। তাদেরকে খাদ্য ও পরিবহন সংক্রান্ত লজিস্টিক সহায়তা দিতে রাজ্য পুলিশকে আহ্বান জানানো হয়। আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ সহ কর্নাটক রাজ্য পুলিশের একটি টিম ছিল। ওদিকে মালদা থেকে সূত্রগুলো দাবি করছেন, আটক ওই বাংলাদেশীদেরকে পুশব্যাক করার জন্য তুলে দেয়া হয় বিএসএফের হাতে। তবে এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কর্নাটক পুলিশ, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এমনকি বিএসএফ। এ বিষয়ে বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত কোনোই তথ্য পান নি তারা।
ওদিকে সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালী বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদনে বলেছেন, ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে বাংলাদেশী সন্দেহে নারী ও শিশুসহ যে ৫৯ ব্যক্তিকে আটক করে গত সপ্তাহে কলকাতা-সংলগ্ন হাওড়ায় নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে আসার পরে ঐ ৫৯ জনকে বালির নিশ্চিন্দা এলাকায় পুলিশের তত্ত্বাবধানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আটক রাখা হয়েছিল। কথিত ওই বাংলাদেশীদের হাওড়ায় নিয়ে আসার পর থেকে তাদের ওপরে নজর রাখছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এ.পি. ডি.আর-এর সদস্যরা। সংগঠনটির সম্পাদক ধীরাজ সেনগুপ্ত বলছিলেন, শুক্রবার নিশ্চিন্দার ওই ভবনটিতে গিয়ে আমরা দেখি যে সেখানে তারা কেউ নেই। তাদের পুশব্যাকই করে দেয়া হয়েছে। এটা জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে আমাদের কাছে নিশ্চিত করেছে। ওদিকে বাংলাদেশের যশোরে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বিজিবির কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেলিম রেজা বিবিসিকে বলেছেন, ব্যাঙ্গালোর থেকে আনা ৫৯ জনের পুশব্যাক নিয়ে তাদের কাছে কোনও খবর না থাকলেও গত এক সপ্তাহে তার নিয়ন্ত্রণাধীন সীমান্ত এলাকা থেকে কমপক্ষে নয়জনকে কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য আটক করা হয়েছে। তিনি জানান, গত একমাসে এরকম আটকের সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৩০।
এছাড়া খুলনা, চুয়াডাঙ্গা এবং ঝিনাইদহ সীমান্তেও অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলে বিজিবির কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন। ব্যাঙ্গালোরে আটককৃতদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করার পরিকল্পনা নিয়েই তাদের ব্যাঙ্গালোর থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল কড়া পুলিশ প্রহরায়। তবে কোন কর্মকর্তা বা কোন সরকারি বিভাগই এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু জানাতে চাইছেন না। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, একদিনে নয়, চার-পাঁচ দিন ধরে ছোট ছোট দলে ভাগ করে তাদের সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, গোটা বিষয়টা নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক হৈচৈ হয়েছে। তাই গোপনীয়তার স্বার্থে নিশ্চিন্দার ওই ভবনটি থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশের গাড়িও ব্যবহার করা হয় নি। প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে বিষয়টির নজরদারি করা হয়েছিল বলেও জানা যাচ্ছে। পেট্রাপোল সীমান্তের কাছাকাছি কোনও এলাকা দিয়েই তাদের পুশব্যাক করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন।
কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস বলছে, তাদের দেশের কথিত নাগরিকরা যে ব্যাঙ্গালোরে ধরা পড়েছিলেন, তাদের কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের কোথায় রাখা হয়েছে, এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয় নি তাদের। ওই ব্যক্তিরা যে বাংলাদেশেরই নাগরিক, তা নিশ্চিত করার জন্য ‘কন্স্যুলার অ্যাক্সেস’ দেয়ার কথা। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে যেহেতু কিছু জানানোই হয় নি, তাই উপ-দূতাবাসও কন্সুলার সেবার আবেদনও করতে পারে নি। যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ওই কথিত বাংলাদেশীদের রাখা হয়েছিল, সেই ভবনটির দায়িত্বে থাকা বালি-জগাছার ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক অসিতবরণ ঘোষ বিবিসিকে বলেন, আমার কাছে শুধু কিছু মানুষকে রাখার জন্য একটি ভবনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছিল। ওই সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি যেহেতু আমার দায়িত্বে, তাই আমি চাবি দিয়েছিলাম। ওখানে কাদের রাখা হয়েছিল, তারা সেখানে আছেন কী না, বা না থাকলে কোথায় গেলেন, এ ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলছেন, আমরা কিছু বলতে পারব না। বিএসএফ অবশ্য এর আগে নানা সময়ে বিবিসিকে জানিয়েছে যে ‘পুশব্যাক শব্দটি তাদের অভিধানে নেই।’ তারা বলে থাকে, কোনও বাংলাদেশীকে বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশের জন্য আটক করা হলে হয় তারা স্থানীয় পুলিশের হাতে তুলে দেয়, অথবা ওই বাংলাদেশীরা যদি পাচারের শিকার হয়েছেন বলে বিএসএফ-এর মনে হয়, তাহলে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিজিবি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু ভারতের নানা রাজ্যে বাংলাদেশী সন্দেহে আটক ব্যক্তিদের যে মাঝে মধ্যেই পুশ-ব্যাক করে দেয়া হয় তা নিশ্চিত। উত্তর ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের বাংলাদেশী সন্দেহে আটক করে তাদের পুশব্যাক করে দেয়া হয়েছিল বলেও জানাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
২০০৯ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর’ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো ছাড়া অন্য রাজ্যে বাংলাদেশী সন্দেহে কাউকে আটক করা হলে তাদের বিরুদ্ধে বিদেশি আইনের ১৪ নম্বর ধারায় ফৌজদারি অপরাধের মামলা না করে বিদেশি নাগরিকপঞ্জীকরণ দপ্তর বা এফ আর আর ও-র সামনে হাজির করিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে এসে বিএসএফ-এর হাতে তুলে দিতে বলা হয়েছে। তারাই বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবে, এমনটাই লেখা আছে ওই এসওপি-তে। মানবাধিকার সংগঠন মাসুমের প্রধান কিরীটী রায় বলছেন, একদিকে যেমন ব্যাঙ্গালোরের পুলিশ ভাল কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা না করে, তেমনই আবার বেআইনি দিকটা হচ্ছে তারা যে বাংলাদেশীরই নাগরিক, সেটা নিশ্চিত কীভাবে করা হল? তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কোনও আদালতে কেন তোলা হল না? যেখানে ভারতের আইন অনুযায়ী আটক করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে তোলার কথা, সেখানে একমাসেরও বেশি সময় তারা আটক রইলেন। কমনওয়েলথ হিউমান রাইটস ইনিশিয়েটিভ ভারতে আটক বাংলাদেশীদের নিয়ে কাজ করে থাকে। সংগঠনটির প্রোগ্রাম হেড মধুরিমা ধানুকা সম্প্রতি বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, ওই এসওপি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তারা এই এসওপি-র বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলাও করেছেন।