ভারী মনে হলে একটু নামিয়ে নিয়েন ভাই – তবু আব্বু যেন পরে না যায় !!
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শফিউর রহমান (৫৫) করোনাভাইরাসে আক্রা’ন্ত হয়ে মা’রা গেছে। তার বাড়ি নওগা জেলায়। হাসপাতালের উপ-পরিচালক সাইফুল ফেরদৌস জানান, মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফিউর রহমানের (৫৫) মৃ’ত্যু হয়।
তার লা’শ দা’ফনে স্থানীয়ভাবে যে অসহযোগিতা করা হয়েছে তা নিয়ে নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জয়া মারিয়া পেরেরা তার ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার আবেগঘন পোস্টে এক বেদনাদায়ক স্মৃতি ফুটে উঠেছে।স্ট্যাটাস তিনি লিখেন, ‘করোনায় আক্রা’ন্ত হয়ে মা’রা যাওয়া বন কর্মকর্তা শফিউর রহমানকে নিয়ামতপুরের রসুলপুর ইউনিয়নের পানিহারা গ্রামে তার পারিবারিক ক’বরস্থা’নে দা’ফন করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার দুপুর বারটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে।
করোনায় আক্রা’ন্ত হয়ে মৃ’ত ব্যক্তির দা’ফন সং’ক্রান্ত নির্দেশনা মেনে জানাজার নামাজ শেষে রাত ৯ টায় তাকে দা’ফন করা হয়। দা’ফন কার্যক্রমে সহায়তা করেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। নিয়ামতপুরে আজই প্রথম একজন করোনায় মা’রা যাওয়া ব্যক্তির দা’ফন সম্পন্ন হলো। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন লা’শ নিয়ে রওনা হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। তারা চারটি পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম), হ্যান্ড গ্লাভস আর মাস্ক চেয়েছিল। এগুলো কারও মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেও চলতো। কিন্তু নিজে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলাম দা’ফন কার্যক্রমে স্থানীয়ভাবে কোন বি’ঘ্ন হতে পারে আশং’কা থেকে। এর আগে বিভিন্নভাবে জেনেছি করোনায় মা’রা যাওয়া মানুষের দা’ফনে স্বজনদের তী’ব্র অবহেলার কথা।
নিজ আগ্রহ থেকে আমার সাথে যোগ দিয়েছিলেন সহকর্মী বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিল্লুর রহমান, ওসি হুমায়ুন কবির এবং উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. শরিফুল। শুরু থেকেই কত সমস্যা! লা’শ বহনের খাটিয়া দিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনীহা। কিন্তু আমি যাওয়াতে তো আর না করার উপায় নেই! অতএব ব্যবস্থা হলো।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যদের আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না। কিন্তু চারজনে খাটিয়াসহ লা’শ বইতে পারছিলেন না। আরেকটু সহযোগিতার দরকার ছিল। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একজন যিনি পিঠে জীবাণুনাশক স্প্রে মেশিন এবং হাতে টর্চ লাইট বহন করছিলেন তিনি সহযোগিতা করতে চাইলেন। কিন্তু তার পিপিই নেই। অতএব তাকে অনুমতি দিতে পারছিলাম না!
মৃ’তের ভাই বিকেল থেকেই পিপিই পরে ঘুরছিলেন। তাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খাটিয়া বইতে সহায়তা করার অনুরোধ করলাম। বলামাত্র সেখান থেকে এক প্রকার দৌঁড়ে চলে গেলেন! আর এলেন না। চারপাশে কোন আত্মীয় স্বজন নেই। অন্ধকারে ভুতুরে পরিবেশ! মৃ’ত ব্যক্তির দুটো সন্তান কেঁদেই চলেছে। ওরা কাছেও আসতে পারছে না। ছটফট করছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চারজনে তখনও লা’শের খা’টিয়া উঠানোর চেষ্টা করছে। উঠানোর পর এগুতে পারছেনা।
আবার নামিয়ে ফেলছে। বেশ ভারী। সদ্য প্রয়াত প্রিয় পিতার এমন অ’সহায় অবস্থা কোন সন্তান মেনে নিতে পারে না। বড় সন্তান নাসিম যে এবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে সে কাতর কন্ঠে অনুরোধ করতে লাগলো সে খাটিয়া ধরতে সাহায্য করবে কিনা? কষ্ট হলেও তাকে ‘না’ বললাম। আরেকটা পিপিইর ব্যবস্থা হলো। সেটা পরানো হলো কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সে সদস্যকে যিনি টর্চলাইট এবং জীবানুনাশক স্প্রে বহন করছিলেন। তারা মিলে খাটিয়া উঠালেন। এবার টর্চ জ্বেলে সামনে পথ দেখানোর জন্য একজনকে খুঁজছিলাম। ডাকাডাকি করলাম। অনুরোধ করলাম। আত্মীয় স্বজন কেউ এলোনা! নিরাপদ দূরত্বে থেকে শুধু একটা টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাবে এর জন্যও কোন স্বজন রাজী হয় না! যেহেতু জা’নাজা শেষ তাই ইমাম সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তাকেই বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম টর্চ জ্বেলে পথ দেখিয়ে লা’শবহনকারীদের সহায়তা করার জন্য। তিনি অনুরোধ রাখলেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য আর ইমাম সাহেবের আন্তরিক সহযোগিতায় অবশেষে দা’ফন সম্পন্ন হলো।
দা’ফন কার্যক্রমে আত্মীয়-স্বজনদের এমন আচরণ দেখে মৃ’তের স্ত্রী আর সন্তানদুটো কতটা কষ্ট পেয়েছে অনুমান করতে আমার বুক কাঁ’পছে! ওরা ভাইবোন একে অন্যকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁ’দছিল! নাসিম চিৎকার করে লা’শবহনকারীদের বলছিল ‘ভাই ভারী মনে হলে একটু নামিয়ে নিয়েন, তবু আব্বু যেন পরে না যায়! আমি, আমার সহকর্মী জিল্লুর, ওসি সাহেব আর উপজেলা বন কর্মকর্তা পুরো দৃশ্য দেখে কেমন বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম! করোনা যে কত কি শিখাবে কে জানে? ফেরার পথে যখন দেখি রাত সাড়ে৯ টা সদরের হিন্দু পাড়ার মোড়ে চার জনে ব্যপক ক্যারাম খেলছে। মেজাসটা আর ঠিক রাখতে পারলাম না! এই আমাদের করোনার ভ’য়? করোনাকে কোন ভ’য় নেই, কোন নিয়ম কেউ মানবেনা। আবার করোনায় মা’রা গেলে তার প্রতি এত অবহেলা? চারজনকেই পুলিশের জিপে তুলে দিলাম।
সাথে প্রিয় ক্যারামখানাও! অভিভাবকরা ঘরে বসে প্রিয় সন্তানের খোঁ’জ রাখতে পারেনি এখন থানায় এসে খোঁ’জ নিক! রাত ২টা পেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন এখনও কা’ন্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আজ থেকে প্রায় চারবছর আগে আমিও বাবার জন্য এভাবে কেঁ’দেছিলাম। তবে পার্থক্যটা হলো আমি আমার বাবাকে শেষ বারের মতো জরিয়ে ধরে কাঁ’দতে পেরেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যহত নাসিম আর তার ছোট বোন তা পারেনি! শফিউর সাহেবের বিদেহী আত্মা জান্নাতবাসী হোক। আল্লাহ শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এ শোক সইবার শক্তি দিক। আমিন।’