যে স্বপ্নে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন রোহিঙ্গা তরুণীরা !!
বিয়ে করে সংসার পাততেই দল বেঁধে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন রোহিঙ্গা তরুণীরা! এমনটি জানিয়েছেন কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ট্রলার ডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া বেশ কয়েকজন তরুণী।
কক্সবাজারের টেকনাফের বঙ্গোপসাগরে সোমবার গভীর রাতে ট্রলারডুবির ওই ঘটনায় অন্তত ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। সাগর থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও নিখোঁজ অন্তত ৫২ জন। তাদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী।
মর্মান্তিক ওই ঘটনায় দুই দালালকে আটক করা হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সহকারী পরিচালক (গোয়েন্দা) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম হামিদুল ইসলাম জানান, ১৩৮ জনের মধ্যে নিখোঁজ ৫২ জন। তাদের উদ্ধারে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।
তিনি বলেন, ‘উদ্ধার অভিযানকালে ওই বড় বোট থেকে দুই দালালকে আটক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরপর আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
উদ্ধার হওয়া টেকনাফের শামলাপুর ক্যাম্পের তরুণী খতিজা বেগম বলেন, ‘বাবা নেই, তাই যৌতুক দিয়ে বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ অন্ধকার চিন্তায় জীবনটা এলোমেলো চলছে। পরিচিতদের মাধ্যমে জেনেছি, মালয়েশিয়ায় স্থানীয় ও প্রবাসীরা বিনা যৌতুকে তরুণীদের সম্মান দিয়ে বউ করে নেন। সংসারি হতেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হয়নি।’
একই কথা বলেন মধুরছড়া ক্যাম্প থেকে ট্রলারে ওঠা রোকসানা বেগম, জাদিমুরার হোসনে আরা, লম্বাশিয়ার ইয়াসমিন। তারা বলেন, ‘ক্যাম্পে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছে। স্বজাতিরাই অসহনীয় আচরণ করে। এখানে সময়টা অতিবাহিত হলেও বুড়িয়ে যেতে হচ্ছে। তাই পরিচ্ছন্ন ভবিষ্যতের সন্ধানে আমরা ঝুঁকি নিয়েছি।’
উদ্ধার হওয়া এসব রোহিঙ্গা তরুণীর সঙ্গে রয়েছেন কিছু বিধবা ও স্বামী-পরিত্যক্তাও। তাদের মধ্যে নূর বানু ও ছলেমা খাতুন বলেন, ‘কোনো একটা কাজে যোগ দিয়ে সন্তান ও নিজেদের সামনের দিনগুলো সুন্দর করার আশায় আমরা ট্রলারে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিলাম। এভাবে মাঝ সাগরে ট্রলার ডুবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে কল্পনাও করিনি।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি জাগো নিউজকে এমন তথ্য দেন। তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা ভেঙে যাওয়া নিজেদের স্বপ্নের কথা বলার পাশাপাশি আরও জানান, অর্থলোভী পাচারচক্র ইচ্ছা করেই অমানবিকভাবে সাগরের মাঝপথে ট্রলারটি ফুটো করে ডুবিয়ে দিয়েছেন— এমন ধারণা তাদের। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে মৃতের সংখ্যা কম হয়েছে বলে জানান উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা। ডুবে যাওয়া ট্রলারে ১২০ থেকে ১২৫ নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল।
সূত্র মতে, প্রশাসনিক কড়াকড়িতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগরপথে মালয়েশিয়া মানবপাচার চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সোমবার রাতে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটি ডুবে যায়। কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ঘটা ট্রলারডুবির ঘটনায় নিহত নারী-শিশুসহ ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনায় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭১ জনকে। উদ্ধার ও নিহতদের মাঝে অধিকাংশই নারী। যাদের সিংহভাগই তরুণী। এখনও কয়েকজন নিখোঁজ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে নিখোঁজদের মাঝে অনেকে সাঁতরে সেন্টমার্টিনের তীরে ফিরেছে বলে খবর এসেছে।
কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিজিবি ও সেন্টমার্টিন বোট মালিক সমিতির পাশাপাশি উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছে বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টারও। কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার লে. নাঈম-উল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
উদ্ধার হওয়াদের বরাত দিয়ে নাঈম বলেন, সোমবার সকালে স্থানীয় জেলেদের মাধ্যমে ট্রলারডুবির খবর পাওয়ার পর উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। টেকনাফ-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সৈকতের বাহারছড়া উপকূল হয়ে দেড় শতাধিক জনের মতো রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে সোমবার রাতের আঁধারে দুটি ট্রলারে ওঠে। গভীর রাতে হঠাৎ একটি ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। পরে ধীরে ধীরে ট্রলারটি পানিতে ডুবে যায়। ভয়ে এবং সাঁতার না জানায় শিশু ও নারীদের অনেকে ডুবে যান।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুর রব জানান, উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বলেছেন, মালয়েশিয়া যেতে জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের রাতের আঁধারে ট্রলারে তুলে দেয় দালালচক্র। অন্তত বিয়ে করে নিরাপদ জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যেতে ঝুঁকি নেন তারা।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। কঠোর নজরদারি থাকায় গত বছর আদমপাচারকারি চক্র অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যেতে ট্রলার ভিড়াতে পারেনি। মহেশখালী, কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর, নাজিরারটেক, মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া, সোনাদিয়াসহ আরও কয়েকটি স্থানে মালয়েশিয়া নেয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো করা কয়েকশ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সোমবার চক্রটি রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলার সাগরে নামায়।
উদ্ধার হওয়াদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দালালদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ। এত মৃত্যুর পরও রোহিঙ্গারা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা না মানলে এমন মর্মান্তিকতা রোধ করা অসম্ভব। মানবপাচার নিয়ে কাজ করা জিও-এনজিও ও জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ানো দরকার বলে মন্তব্য করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
দুপুরে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সাগরে ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজদের উদ্ধারে বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার, নৌবাহিনী ডুবুরি ও কোস্টগার্ডের প্রশিক্ষিত টিমের সদস্যরা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
এদিকে মানবপাচার রোধে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা জোর তৎপরতা ও প্রচারণা চালালেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এটি। অভিযোগ আছে, টেকনাফ সদরের লম্বরী, হাবিরছড়া, মিঠাপানিরছড়া, বাহারছড়ার নোয়াখালী পাড়া, জুম্মাপাড়া, কচ্চপিয়া, বাঘঘোনা বাজার, মহেশখালী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর, চৌফলদন্ডী, নাজিরারটেকসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে চিহ্নিত কতিপয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তি ও সাংবাদিকের সহায়তায় এ অপতৎপরতা চলছে।