রাজধানীতে বেড়েছে টু লেট, জুনেই বাসা ছাড়ছে অসংখ্য পরিবার !!
রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে শুরু করে বস্তির হতদরিদ্র মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে মহামারি করোনাভাইরাস। এ মহামারিতে শ্রেণিভেদে ঢাকায় বসবাসরত কমবেশি সকলেই আর্থিক সংকটে পড়েছেন।
তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশে করোনা পরিস্থিতি চলছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ পূর্বে যে জীবনযাপন করতেন এ পরিস্থিতিতে সেটি চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যয় কমাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করছেন। অনেকে বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না। আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতার ফলে অনেকেই বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসা, আবার অনেকে বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন।
ইতোমধ্যেই ঢাকাতে জায়গায় জায়গায় বেড়েছে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন। বুধবার (২৪ জুন) রাজধানীর হাতিরপুল সেন্ট্রাল রোডের একটি ফার্মেসির সামনের দেয়ালে অসংখ্য বাসা ভাড়ার সাইনবোর্ড-পোস্টার ঝুলতে দেখা গেছে। কোনোটিতে ফ্লাট ভাড়া, কোনোটিতে সাবলেট আবার কোনোটিতে রুমমেট আবশ্যক শিরোনাম লেখা রয়েছে। কয় রুমের বাসায় কী কী সুবিধা আছে ইত্যাদিও উল্লেখ করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রায় প্রতিটিতে ১ জুলাই থেকে বাসা ভাড়া দেয়া হবে বলে উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয় ফার্মেসী মালিক আব্দুল হামিদ জানালেন, তিনি গত ২০ বছর যাবত হাতিরপুল সেন্ট্রাল রোড এলাকায় বসবাস করছেন। এত টু-লেট কখনও দেখেননি। করোনাভাইরাসের কারণে তার পরিচিত অনেকেই বড় বাসা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন।রাজধানীর ধানমন্ডি, লালবাগ, আজিমপুর, এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেশিরভাগ বাসা বাড়িতেই ভাড়ার বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো- বড় বড় কোম্পানি নির্মিত বহুতল ভবনেও বাসা ভাড়ার সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়।এদিকে, করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকার ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালা চরম বেকায়দায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ধানমন্ডি এলাকার এক পোশাক ব্যবসায়ী জানান, ধানমন্ডি এলাকায় ৬০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া, ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ির চালক এবং সংসারের অন্যান্য খরচ বাবদ মাসে ২ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ খরচ চালাতে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু গত তিন মাস যাবত ব্যবসা এক প্রকার বন্ধ থাকায় এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে গিয়ে তিনি অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আগামী কয়েক মাস এমন অবস্থা চলতে থাকলে তাকেও বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসায় উঠতে হবে।
রাজধানী জিগাতলার বাসিন্দা কাজল খন্দকার নিউ মার্কেটের একটি দোকানে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। নিজের বাড়িতে থাকেন বলে বাড়ি ভাড়া লাগে না। তবে যে টাকা বেতন পান তাতে সংসার ও ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার পেছনে সবটুকু খরচ হয়ে যায়। গত দুই মাসেরও বেশি সময় যাবত মার্কেট বন্ধ থাকায় আয় রোজগার বন্ধ।
কাজল খন্দকার বলেন, ‘এ মাসে বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৫ হাজার টাকা। বিল পরিশোধ না করলে লাইন কেটে দেবে। তাই পরিচিত একজনের কাছে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ৫ হাজার টাকা ঋণ করে এনে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করি।’তিনি বলেন, ‘এখন মার্কেট খুললেও বেচাকেনা না থাকায় মালিক জানিয়ে দিয়েছেন এই অবস্থায় তার পক্ষে বেতন পুরোপুরি দেয়া সম্ভব না। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে চলব তা নিয়ে তিনি ভীষণ চিন্তিত।’
রাজধানীর নীলক্ষেতের পুস্তক ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার বইয়ের দোকানে বই সাপ্লাই দিতেন। আয়ও ভালো ছিল। কিন্তু করোনার কারণে এখন বই সরবরাহ বন্ধ। আয় রোজগার বন্ধ থাকায় গত দু’মাস বাসা ভাড়া দিতে পারেননি। বাড়িওয়ালা প্রতিদিন ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এ কারণে তিনি এ মাসের শেষে ঋণ করে বাসা ভাড়া পরিশোধ করে স্ত্রী সন্তানকে আপাতত গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন বলে ভাবছেন।
আজিমপুর নতুন পল্টনের কম্পিউটার ব্যবসায়ী সোলাইমান হোসেন জানান, স্থানীয় ইরাকি কবরস্থানের সামনে প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে তার মতো ব্যবসায়ীদের মুখে শুধু হা হুতাশ শুনতে পান। অনেকেই ব্যবসা মন্দা হওয়ার কারণে বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসায় ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে রনি মার্কেট এলাকার বাসিন্দা রেনু আক্তার আজিমপুর এলাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। তার স্বামী রিকশাচালক। স্বামীর একার আয়ে তিন সন্তানসহ ৫ জনের পরিবারের খরচ না চলার কারণে রেনু আক্তার গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে যে বাসায় কাজ করতেন সে বাসা থেকে আপাতত তাকে যেতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।
জাগো নিউজকে রেনু আক্তার জানান, বস্তির দুটা কক্ষ ৫ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতেন। এখন তিনি কাজে যেতে পারেন না বলে দুই মাসের ভাড়া দিতে পারেননি। ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন মালিক। এই অবস্থায় কোথায় যাবেন, কী করবেন কীভাবে সংসার চলবে- এই চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না বলে জানান রেনু আক্তার।
করোনা পরিস্থিতির কারণে আর্থিক সংকটে শুধু ভাড়াটিয়ারাই নয়, বিভিন্ন এলাকার বাড়ির মালিকরাও বিপাকে পড়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে অনেকেই ভাড়া দিতে পারছেন না, এই অবস্থায় কাউকে টাকার জন্য চাপ দিতে পারছেন না। ভাড়াটিয়ারা করোনা দোহাই দিয়ে ভাড়া পরিশোধ না করলেও প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল গ্যাস বিলসহ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ থেমে নেই।
লালবাগ এলাকার এক বাড়িওয়ালা জানান, তার তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। একটিতে নিজে থাকেন এবং বাকি দুটি ভাড়া দিয়েছিলেন। করোনা পরিস্থিতির জন্য গত মাসে ওই দুটি ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে চলে যান। নতুন ভাড়াটিয়ার জন্য টু-লেট ঝুলিয়ে রাখলেও এখন পর্যন্ত ফ্লাটে কেউ না ওঠাই মাসে ৬০ হাজার টাকা আয় কমে গেছে।