সিঁড়িতে পড়ে ছিল মরদেহ , ডাকলেও সাড়া দেয়নি কেউ !!
‘চারতলা থেকে তিন তালা নামছি। দুই তালার দুইটা সিঁড়ি নামার পর আর নামতে পারতাছে না। শরীর একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে। আমি বললাম যে বসবা? উনি বলল যে বসবে। বসাইয়া দিছি আর হেলে পড়ছে। তখন আমি কান্নাকাটি করতাছি আর জল ছিটা দিতেছি। তিন তালার এক ভাড়াটিয়ার কাছে আমার মেয়ে গিয়ে বলল যে আন্টি আমারে একটু জল দেন। মেয়েরে ধমক দিয়ে দরজা আটকায়া দিছে। একটু জল দেয় নাই।’ গতকাল রবিবার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে করোনা উপসর্গ নিয়ে নিজ বাসার সিঁড়িতেই মারা যান খোকন সাহা। খোকন সাহার মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া করুণ ঘটনা এভাবেই বলছিলেন তার স্ত্রী তৃশা সাহা।
খোকন সাহা নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা এলাকায় একটি বাড়ির চতুর্থ তালায় বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। বেশ কয়েকদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন। এরমধ্যেই অবস্থা গুরুতর হয় তার। হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ফোন করে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের ডাকতে থাকেন স্ত্রী তৃশা সাহা। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। বাধ্য হয়ে শাশুড়ির সহযোগিতা নিয়ে নিজেই হাসপাতালে নেওয়ার জন্য নামতে থাকেন। কিন্তু অসুস্থ শরীর সিঁড়ি বেয়ে নামার ধকল নিতে পারেনি। তিন তলাতে নামার পরেই শরীর ছেড়ে দেয়।
তৃশা সাহা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় আছিল। আমরা নিচে নামানোর চেষ্টা করতাছিলাম। অ্যাম্বুলেন্স দিয়া আমরা ঢাকা নিয়া যাইতাম। সবাইরে ডাকছি একটা লোকও আসে নাই। কেউ নাকি ধরবে না। আমি আমার শাশুড়ি আর আমার মেয়ে ধইরা নামানোর চেষ্টা করি। তিন তালার ভাড়াটিয়ার কাছে আমার মেয়ে পানি চাইছিল। ধমক দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিছে।’
সিঁড়িতে যখন খোকন সাহা ছটফট করছিলেন তখন সন্তানের এমন অবস্থা দেখে বৃদ্ধা মা দৌড়ে চার তালায় গিয়ে পানি নিয়ে আসেন ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য। মুখে সামান্য পানি দেওয়া মাত্র সেখানেই প্রাণ যায় খোকন সাহার। এরপর প্রায় তিন ঘণ্টা সেখানেই পড়ে ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কেউ এগিয়ে আসেনি। করোনার ভয়ে কেউ এগিয়ে না এসে তাদের আত্মীয়রা ফোন করে খবর দেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে। কাউন্সিলর খোরশেদকে যখন ফোন করা হয় তখন তিনি মাসদাইর কবরস্থানে করোনা আ’ক্রান্ত হয়ে মৃত এক ব্যক্তির লা’শ দাফনে ব্যস্ত ছিলেন। সেই আত্মীয়ের কাছে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তারা ব্যবস্থা করে। কিন্তু তার অনুরোধেও কেউ এগিয়ে আসেননি। কয়েক ঘণ্টা পর আবারো ফোন করা হলে কাউন্সিলর খোরশেদ তার স্বেচ্ছাসেবী টিম নিয়ে ছুটে যান মৃতের সৎকারে। স্বেচ্ছাসেবী দলের সাহায্যে সিঁড়িতে পড়ে থাকা লা’শ নামিয়ে নিয়ে আসেন। নিজেদের গাড়ি দিয়ে শ্মশান পর্যন্ত নিয়ে আসেন লা’শ। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ এগিয়ে আসেননি। যে কারণে মুখে আগুন (মুখাগ্নি) দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে কাউন্সিলর খোরশেদের কাঁধে। সেই দায়িত্ব তিনি সাদরে গ্রহণ করেন। লা’শ নিয়ে চলে আসার সময় নিহতের স্ত্রীকে কথা দিয়ে আসেন যে যথাযথ সম্মানের সাথেই তার সৎকার করবেন তিনি।
খোকন সাহার সৎকার প্রসঙ্গে তার স্ত্রী তৃশা সাহা বলেন, ‘আমাদের আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কেউ আসে না, কেউ মরা ধরে না। আমি কার ভরসায় করুম? আমার তো ছেলে নাই। যাদের ছেলে নাই তাদেরটা তো আত্মীয়রাই করে কিন্তু আমার তো কেউ যায় নাই। তাই কাউন্সিলর ভাইকে বলছি যে তিনি যাতে সব করে।’
মানুষের এমন মানুষ্যত্বহীনতা দেখে এই মহাদুর্যোগের সময়ে মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করে কাউন্সিলর খোরশেদ বলেন, ‘এই যে প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনরা সাড়া দিচ্ছে না। এতে মানবিক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। আমরাও মানুষ, আপনারাও মানুষ। আমরা যদি পারি আপনারা কেন পারবেন না। সেই মেয়ে দুইটির কথা চিন্তা করে দেখেন তাদের মনের কি অবস্থা। তার বাবাকে তারা দীর্ঘক্ষণ সিঁড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখেছে। আপনাদের প্রতি অনুরোধ জানাই মাস্ক পড়ে, গ্লাভস পড়ে যে কোনো করোনা রোগীর সেবা করতে পারবেন। কোনো ভয়ের কারণ নাই। দয়া করে আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীর মৃত্যুর পর তাদের সম্মান রক্ষা করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার (খোকন সাহা) এক শ্যালক, এক ভাই ফোন করে আমাকে জানান যে তাদের এক আত্মীয় মারা গেছে। আমি তাদের অনুরোধ করি যাতে তারা নিজেরা কোনো ব্যবস্থা করে। কিন্তু তারা সাহস করে কেউ এগিয়ে আসেননি। আমরা গিয়ে দেখি তিন তালার সিঁড়িতে পড়ে আছে। আমার বিশেষ বার্তা হচ্ছে, হিন্দু মুসলিম কোনো ধর্ম নিয়ে নয়। মানুষের প্রতি মানবতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি একজন নারায়ণগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বন্ধুদের নিয়ে তিনি ৭ তলা বাড়ি করেছেন। সেই বন্ধুরা পর্যন্ত খোকন সাহার দুই কন্যার ডাকে সাড়া দেয়নি।’