সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসার শঙ্কায় বাংলাদেশি প্রবাসীরা !!
মুখে খোঁচা খোঁচা হালকা ধূসর রঙয়ের দাড়ি, শরীরে লম্বা গোলাপি রঙয়ের পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপি। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে বেশ পরিচিত দোকানী তরিকুল ইসলাম। সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়ার লেম্বু রোডে তার দোকান রয়েছে। শাক-সবজি ও অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। তার গ্রাহকের অধিকাংশই বাংলাদেশি প্রবাসী।
কিন্তু দেশটির একটি নির্মাণাধীন স্থাপনায় কয়েকজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর তার দোকানে গ্রাহক কমে গেছে। অনেক গ্রাহক দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় অথবা কর্তৃপক্ষ জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়ায় এখন ক্রেতাশূন্য তরিকুলের দোকান।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কারণে এশিয়াজুড়ে অভিবাসী শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছেন। এই শ্রমিকরা অনেক সময় এক কক্ষে গাদাগাদি করে অসুস্থকর পরিবেশে বসবাস করেন। এখন হাজার মাইল দূরে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরতে চান তারা।
৫২ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশি প্রবাসী বলেন, অনেকেই দেশে ফিরে গেছেন। সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়ার লেম্বু রোডের তার দোকানের সামনে অল্প কয়েকজন ক্রেতা মুখোশ পরে ফলমূল ও শাক-সবজি কেনার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তরিকুল সবজি বিক্রি করতে করতে বললেন, মানুষ যখন পরিবার এবং জীবনের কথা চিন্তা করে, তখন তারা টাকা-পয়সার ব্যাপারে কিছু ভাবে না।
ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিনিধি রোববার ওই এলাকায় যান। সেখানে গিয়ে অন্যান্য সময় যেমন কর্মচাঞ্চল্য কিংবা রাস্তায় যানবাহন দেখা যায়; সেসবের কিছুই পাওয়া যায়নি। অনেকটা শান্ত রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মীরা টহল দিচ্ছেন।
সিঙ্গাপুরে এখন পর্যন্ত ৯০ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক রয়েছেন; যারা একটি নির্মাণাধীণ স্থাপনায় কাজ করছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ওই পাঁচজনের মধ্যে একজনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এক বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
সিঙ্গাপুরে বসবাসরত দক্ষিণ এশিয়ার নির্মাণ শ্রমিকরা প্রায়ই ১২ আসনের এক গণরুমে গাদাগাদি করে থাকেন। তাদের সবার জন্যই থাকে মাত্র একটি বাথরুম। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তারের ঘটনায় দেখা গেছে যারা খুবই কাছাকাছি থাকেন তাদের শরীরে দ্রুত সংক্রমণ ঘটেছে। এরমধ্যে জাপানে ঘাঁটি করা ব্রিটিশ প্রমোদতরী প্রিন্সেস ডায়মন্ড এবং চীনের কারাবন্দিদের মাঝে করোনার সংক্রমণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সার্সগোত্রীয় নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৭০৪ জনের প্রাণ কেড়েছে। এতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮০ হাজার ২৬৩ জন।
২৪ বছর বয়সী বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিক কাকন মিয়া। গত কয়েক বছর ধরে সিঙ্গাপুরে আছেন তিনি। কাকন মিয়া বলেন, তারা যেখানে কাজ করেন; সেখানে অনেক বাংলাদেশি আছে। ভাইরাসের সংক্রমণ না ঘটলেও তার অনেক বন্ধু দেশে ফিরে গেছে। শহর ভাইরাস মুক্ত হলে তারা আবার ফিরে আসবে বলে জানিয়েছে।
বেশ কয়েকজন সহকর্মীর পাশে বসে তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত এখানে আছি। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে আমরাও দেশে ফিরে যাবো।সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশন বলছে, তারা সিঙ্গাপুরে বসবাসরত প্রবাসীদের সঙ্গে অনলাইনে এবং ডরমেটরিতে গিয়ে স্বাক্ষাৎ করে দেশে ফেরত না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এমনকি বাংলাদেশি শ্রমিকদের মাঝে স্যানিটাইজার, মাস্ক ও বাংলা ভাষায় লেখা সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করছেন।
হাই কমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান রয়টার্সকে বলেছেন, সিঙ্গাপুর ছেড়ে যাওয়া ঠেকাতে আমরা কিছু তৎপরতা শুরু করেছি। আমরা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি যে, এটা এমন কিছু নয়; যা নিয়ে আমাদের খুব বেশি কিংবা অহেতুক ভীত হয়ে দেশে ফেরত যেতে হবে।
সিঙ্গাপুরে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ধরনের বিধি-নিষেধ নেই। হাই কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, দেশটিতে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি আছেন।
কোনও বাংলাদেশি যখন কাজের সন্ধানে সিঙ্গাপুরে যান তখন তার দেনায় দায় থাকে বৃহৎ। অনেক সময় বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে গিয়ে সেখানে কাজ করে মাসের পর মাস সেই সংস্থার টাকা পরিশোধ করেন। যে কারণে অনেকে চাইলেও দেশে ফেরত আসতে পারছেন না।
২৫ বছর বয়সী মজিদুল হক তেমনই একজন শ্রমিক। তিনি এক মাসের জন্য বাংলাদেশে এসে সোমবার সিঙ্গাপুরে ফিরে গেছেন। মজিদুল বলেন, তার বাবা-মা চান না ছেলে দেশে ফিরে আসুক। পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য তিনিও সেটি অনুভব করেন বলে জানান এই বাংলাদেশি।
সিঙ্গাপুর প্রবাসী এই বাংলাদেশি বলেন, আমার আয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ তার কৃষক বাবার আয়ে চলে না। এছাড়া তার ছোট ভাই-বোনরা স্কুলে যায়।
কিন্তু অন্যান্য শ্রমিকরা বলছেন, সিঙ্গাপুরের উচ্চ-মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সুবিধা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে অনেকেই দেশটিতে অবস্থানের সাহস পাচ্ছেন। সিঙ্গাপুরে দিনে অন্তত দু’বার শ্রমিকদের জ্বর মাপা হয় এবং সন্দেহভাজনদের আইসোলেশনে পাঠানো হচ্ছে।
লেম্বু রোডের একটি ট্রাভেল অ্যাজেন্সির মালিক রওফ নওশাদ। মূলত বাংলাদেশি শ্রমিকদের ঘিরেই রওফের এই ব্যবসা। তিনি বলেন, গত ১৪ দিনে বাংলাদেশিদের দেশে ফিরে যাওয়ার বুকিং বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এমনকি মাত্র একদিন আগে এসে অনেকেই সরাসরি ঢাকাগামী ফ্লাইটের অনুরোধ করছেন।
রওফ বলেন, ঢাকাগামী অনেক ফ্লাইট এখন পুরোপুরি বুকড। যে কারণে এখন তাকে ব্যাঙ্কক অথবা কুয়ালালামপুর রুটে টিকেট বুকিং দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, অতীতে কখনই এটা দেখা যায়নি। আগে তারা ভ্রমণের পরিকল্পনা করতেন। কিন্তু এখন তারা শুধুমাত্র যেতে চায়।
সূত্রঃ জাগো নিউজ