সৌদি প্রবাসী – ১৭ বছর পর দেশে ফিরে দেখলেন থাকার জায়গাটাও নেই !!
সৌদি আরব থেকে নাসির উদ্দিন ফিরেছেন খালি হাতে। ফেরার আগে বৈধ কাগজ না থাকায় তাঁকে সেখানে ১৮ দিন জে’ল খাটতে হয়েছে। তবে দেশে ফিরেই পড়েছেন জটিল স’মস্যায়। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে কেউ তাঁকে নিতে চাইছেন না।এক বোনের স্বামী মা’রা গেছেন, তিনি নিজেই থাকেন ছেলের সঙ্গে। ফলে, ওই বোনও তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতে পারছেন না। ৫২ বছর বয়সী নাসির উদ্দিনের ঠাঁই হয়েছে রাজধানীতে বেস’রকারি সংস্থা ব্র্যাকের সেফ হোমে।
নাসির উদ্দিন দেশে ফিরেছেন ১৪ জানুয়ারি ভোররাতে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর তাঁর চলাফেরা দেখে সেখানে দায়িত্ব পালন করা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা নাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন,তাঁর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। পরে সকালে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সদস্যদের বি’ষয়টি জানালে তাঁর জায়গা মেলে সেফ হোমে। গত মঙ্গলবার কথা হচ্ছিল চট্টগ্রামের সন্দীপের নাসির উদ্দিনের সঙ্গে। বললেন, ২০০৩ সাল থেকে তিনি সৌদি আরবের জেদ্দায় কাজ করছেন।
২০১৫ সালের আগপর্যন্ত একটি কোম্পানির অধীনে একটি রেস্তোরাঁয় জুস মেকার, স্যান্ডউইচ মেকার হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে কোম্পানি তাঁকেসহ অন্য শ্র’মিকদের দেশে পাঠিয়ে দিতে চাইলে শ্র’মিকেরা মা’মলা করেন। কিন্তুকোনো ক্ষ’তিপূরণ পাননি তাঁরা। শুধু পাসপোর্ট হাতে পেয়েছিলেন। পরে দেশটিতে থাকার বৈধ কাগজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে শ্র’মিকের কাজ করে দিন পার করছিলেন। অবশেষে মক্কায় গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশে ফেরত এসেছেন।
নাসির উদ্দিন কোম্পানিতে যখন কাজ করতেন, বাংলাদেশি টাকায় ৩৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পেতেন। এর সঙ্গে বোনাস বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যোগ হলে টাকার পরিমাণ বাড়ত। কোম্পানি থেকেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায়সেখানে তেমন কোনো খরচ ছিল না নাসিরের। তাঁর হিসাবে ২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে থাকা স্ত্রীর নামে কম করে হলেও ২৫ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন। আর এবার যখন খালি হাতে ফিরলেন, তখন তাঁর আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
নাসির উদ্দিন জানালেন, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী রাজধানীতে একটি বেস’রকারি হাসপাতালে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন ওয়ার্ড মাস্টার, আর স্ত্রী ছিলেন নার্স। দুজন ভালোবেসে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন ১৯৯৮ সালে। আর তিনি বিদেশচলে যান ২০০৩ সালে। এবারের আগে নাসির উদ্দিন মাত্র দুবার দেশে আসতে পেরেছিলেন, দুবারে ছিলেন ছয় মাস করে। তাঁর সংসারজীবন বলতে এই এক বছর। এর মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়েছে।
নাসির উদ্দিনের অ’ভিযোগ, দেশে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে একজনের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা জানতে পারেন বিদেশে থাকা অবস্থায়। এরপর ছেলের পরামর্শে স্ত্রীর নামে টাকা পাঠানো বন্ধ রাখেন। তারপর নিজেই স’মস্যায় পড়ে যান বলে ২০১৫সালের পর সেভাবে আর টাকা পাঠাননি। তবে এর আগেই বিভিন্ন সময় প্রায় ২৫ লাখ টাকা তিনি স্ত্রীর নামে করা অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন। নাসির উদ্দিন বললেন, ‘নিজের নামে কোনো অ্যাকাউন্ট খুলিনি। নিজের কোনো সঞ্চয় নেই।
স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমি যখন ভু’ল বুঝতে পারছি, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নিজের জীবনের সব সুখ-আহ্লাদ বাদ দিলাম ওদের জন্য। এখন ওরাই আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমার যাওয়ার কোনো জায়গানেই। কে আমাকে আশ্রয় দেবে, সেই আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে।’ তবে নাসির উদ্দিনের ২১ বছর বয়সী ছেলে ফেরদৌস নাঈম টেলিফোনে বললেন, ‘আমার মা আমার বাবাকে তা’লা’ক দিয়েছেন দুই বছর আগে।
তিনি যে ২৫ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন, তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাতে বলেন। তিনি আমাদের ভরণপোষণও দেননি। মায়ের চরিত্র নিয়েও বাজে কথা বলছেন। আর এই পর্যন্ত ছয় লাখ টাকার মতো পাঠিয়েছেন। আমাকে বা আমার বোনকে জন্মদিয়েই তো তিনি দায়িত্ব শেষ করতে পারেন না, দেশে আমাদের খরচ লাগেনি?’ ফেরদৌস নাঈম অ’ভিযোগ করেন, নাসির উদ্দিন দেশে যত দিন ছিলেন, তত দিনই বাড়িতে অশান্তি করতেন। স্ত্রীকে গ’লাটি’পে মা’রতেও চেয়েছিলেন।
অন্যদিকে, নাসির উদ্দিন বললেন, ‘ছেলেই বাড়িতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা ফোনে জানাত। ছেলেই টাকা পাঠাতে নিষেধ করেছিল। তবে এখন ছেলে কেন এ ধরনের কথা বলছে, তা বুঝতে পারছি না।’ তা’লা’ক প্রসঙ্গে নাসির উদ্দিনজানালেন, তাঁর স্ত্রী মুঠোফোনে তা’লা’কের একটি কপি পাঠিয়েছিলেন, তারপর তিনি এ বি’ষয়ে আর কিছু জানেন না বা তাঁর কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। নাসির উদ্দিনের কাছ থেকে শুধু তাঁর ছেলের নম্বর পাওয়া গেছে। তিনি স্ত্রীর কোনো টেলিফোন নম্বর দিতে পারেননি। অন্যদিকে, ছেলে ফেরদৌস নাঈমও তাঁর মায়ের নম্বর দিতে চাননি। তাই তাঁর সঙ্গে কথা সম্ভব হয়নি।
অভিবাসন নিয়ে কর্মরত বেস’রকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতাচেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসন পরিকল্পনার একটি অংশই হতে হবে, বিদেশ থেকে তিনিকীভাবে, কার নামে টাকা পাঠাবেন, তা পরিকল্পনায় রাখা। অভিবাসী শ্র’মিকদের বিদেশ যাওয়ার আগেই দুটি অ্যাকাউন্ট খোলার বি’ষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার চা’লানো প্রয়োজন।একটি অ্যাকাউন্টে বাবা, স্ত্রী বা সংসারের খরচের টাকা পাঠাবেন। আর একটি নিজের নামে সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট করতে হবে। এতে দেশে ফিরে ওই শ্র’মিককে দিশেহারা হতে হবে না।
ব্র্যাকের ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টারের ব্যবস্থাপক আল-আমিন বিমানবন্দরে গিয়ে নাসির উদ্দিনকে ব্র্যাকের সেফ হোমে নিয়ে যান। বিদেশফেরত অ’সহায়, নি’র্যাতনের শি’কার বা যাওয়ার জায়গা নেই—এ ধরনের শ্র’মিক ফিরলেই ডাক পড়েআল-আমিনের। তিনি নিজেও বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন, পরে তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সাত মাস নি’র্মম নি’র্যাতন সয়ে খালি হাতে ফিরেছিলেন। সমাজের নানাজন খা’রাপ কথা বললেও আল-আমিন পাশে পেয়েছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের।
আল-আমিন বলেন, বিদেশফেরত শ্র’মিকদের অনেকেরই অ’ভিযোগ থাকে, দেশে ফিরে তিনি তাঁর পাঠানো টাকার কোনো ভাগ পাচ্ছেন না। অনেকেরই স্ত্রী বা স’ন্তানদের নামেও অ’ভিযোগ থাকে। তবে কেউ সেভাবে মুখ খুলতে চান না।নাসির উদ্দিন বি’ষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। তাই বি’ষয়টিকে একটি উদাহরণ হিসেবে ধরে অন্য প্রবাসী শ্র’মিকেরা দেশে টাকা পাঠানো, নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা বি’ষয়ে সচেতন হতে পারেন।
সূত্র : প্রথম আলো