হজ শেষে হাজীরা যেসব স্থান ভ্রমণ করতে পারেন !!
প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার জন্য। একই কাতারে শামিল হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা তাওয়াফ করেন আল্লাহর ঘর।আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি ভ্রাতৃত্বের এমন নিদর্শন পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এটা এমন একটি মিলনমেলা, যেখানে সবার মনে একটাই আশা ও উদ্দেশ্য থাকে, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন’। যতদিন আল্লাহর এই ঘর জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, হজ নামক ইবাদত চালু থাকবে, ততদিন অটুট থাকবে মুসলমানের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব।
হজের পাঁচ দিনে মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রচুর সময় পাওয়া যায়। এ সময়টা ইবাদত করার পাশাপাশি ইসলামের নানা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখে নেয়া যায়।
সৌদি আরবের হেজাজের একটি শহর মক্কা। আমাদের পেয়ারে নবীজি মোহাম্মদ (সা.)-এর জম্মভূমি। ইসলামের বহু সমৃদ্ধ ইতিহাস ও নবীজির অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ নগরীতে। যেমন- ‘কুরাইশ বংশধরদের আভিজাত্য, আবু জাহেলের অত্যাচারের করুণ চিত্র’। নবীজি ইসলাম প্রচারে বাধাগ্রস্ত হয়ে এই মক্কা থেকেই ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করে মদিনা গিয়েছিলেন।
মক্কা শরিফ থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে থাকা একটি পাহাড়ের নাম জাবালে নূর। এই পাহাড়ের চূড়ায় থাকা একটি গুহাকে বলা হয় ‘গারে হেরা’ বা ‘হেরা গুহা’। নবুওয়্যত লাভের আগে নবীজি এই গুহায় ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এখানেই সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয়েছিল। আর নবীজির স্ত্রী খাদিজা (রা.) প্রতিদিন তিনবেলা করে, সেই উচুঁ পাহাড়ে উঠে খাবার দিয়ে আসতেন।
পবিত্র কাবাঘরে বসানো আছে একটি কালো পাথর। আরবিতে যাকে বলা হয়- হাজরে আসওয়াদ। নবীজি ৬০৫ সালে কাবার দেয়ালে হাজরে আসওয়াদ পাথরটি স্থাপন করেছিলেন। ইসলাম পূর্ব পৌত্তলিক যুগ থেকেই পাথরটি সম্মানিত হয়ে আসছে। তাওয়াফের শুরুতেই হাজরে আসওয়াদে চুমু দিতে হয়, অবশ্য ভিড়ের কারণে কাছ থেকে না পারলেও দূর থেকে দুই হাত তুলে তালুতে চুমু দিতে হয়। যা বর্তমানে হাজী ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অন্যন্য আকর্ষণ।
আরেকটি বেহেশতি পাথর মাকামে ইবরাহিম ও কাবার পাশে। মাকামে ইবরাহিম সেই পাথর, যে পাথরে দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। সহিহ হাদিসে বর্ণিত কাবা ঘর নির্মাণের সময় আল্লাহর হুকুমে পাথরটি প্রয়োজন অনুযায়ী হজরত ইবরাহিম (আ.) কে নিয়ে ওপরে-নিচে ওঠা নামা করত। পাথরটিতে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পা মুবারকের চিহ্ন আছে এখনও। এর সামনে দু’রাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করলে তা কবুল হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। এটিও হাজী ও পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।
পবিত্র বায়তুল্লাহ শরিফ পৃথিবীর মধ্যভাগে অবস্থিত। সারা বিশ্বের মধ্যে মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্রতার প্রথম স্থানে মসজিদে হারাম এ মক্কাতেই। প্রায় দশ লাখ নামাজি একত্রে সালাত আদায় করতে পারবেন এই মসজিদে।
হজ মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ মুসল্লির স্থান হয়। এতে সুউচ্চ ৯টি দৃষ্টিনন্দন মিনার আছে। মসজিদে হারামে মোট ৮১টি দরজা আছে যা সব সময় মুসল্লিদের জন্য খোলা থাকে। হজ করতে ২০১২ সালের হিসাব অনুসারে মক্কায় ২ মিলিয়ন মানুষ বাস করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই শহরের উচ্চতা ৯০৯ ফুট। আধুনিক মক্কা শহর এখন আরও নান্দনিক। প্রশস্ত সড়ক, নয়নাভিরাম সব স্থাপত্য পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। বাড়তি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন রয়েছে শত শত পাহাড়। পুরো শহরটাই পাহাড়ঘেরা।
মসজিদে হারামের পাশেই ‘আবরাজ আল বাইত’ হোটেলের ওপর স্থাপন করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘড়ি। এর নির্মাণ কাজ ২০০২ সালে শুরু হয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১২ সালে উদ্বোধন করা হয়েছে। পুরো মক্কা শহর থেকে রাতে ১৭ ও দিনের বেলা ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত এ ঘড়িটিতে স্পষ্ট সময় দেখা যায়। ঘড়িটিতে সাদা ও সবুজ রঙের প্রায় ২১০০০ হাজার বাতি ব্যবহার করা আছে।
বিশেষ মুসলিম দিনগুলোয় ঘড়ির ওপর আকাশের দিকে ১০ কিমি. পর্যন্ত ১৬ রঙের আলোর বিচ্ছুরণ হয়। প্রতি ৫ ওয়াক্ত নামাজের সময় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ফ্ল্যাশ লাইটের মাধ্যমে নামাজের ইঙ্গিত দেয়া হয়। এ ছাড়া ঘড়িটির ওপর বড় করে আল্লাহ লেখা রয়েছে। যা চারপাশ থেকে একই রকম দেখা যায়। এ ঘড়ির সময় গ্রিনিচ সময় থেকে তিন ঘণ্টা এগিয়ে।বায়তুল্লাহর সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই আছে আবু জাহেলের বাড়ি। যেটিকে এখন তার প্রতি ঘৃণা স্বরূপ মুসল্লিদের জন্য টয়লেট তৈরি করে দেয়া হয়েছে। একটু দূরেই নবীজির বসতভিটা। যা এখন লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বা
য়তুল্লাহর আরেক পাশে একখণ্ড জমি, তাইসির যাওয়ার পথে পড়ে। এখনও তা অন্ধকার আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের করুণ স্মৃতির সাক্ষী। এখানেই জীবন্ত কন্যাশিশু পুঁতে ফেলা হতো। উড়াল সড়ক থেকে জায়গাটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়।শহরের মধ্যভাগে আছে মক্কা জাদুঘর। এখানে আদি কাবাঘরের নমুনা, জমজম কূপের পূর্বেকার নিদর্শন ও যন্ত্রপাতিসহ নানা দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার প্রতিকৃতি রয়েছে। জাদুঘরের পাশেই কাবাঘরের গেলাফ তৈরির কারখানা।
আরেকটু এগোলেই পড়বে, যেখান থেকে জমজম পানি মদিনা এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় জারে করে সাপ্লাই দেয়া হয়। জিয়ারাত করার জন্য হাজীরা মক্কার জান্নাতুল মাওয়া গিয়ে থাকেন। যেখানে হাজার হাজার সাহাবিসহ নবীজির প্রথম বিবি হজরত খাদিজা (রা.)-এর কবর আছে।
ইসলামিক ইতিহাসের আরেক সাক্ষী সাফা ও মারওয়া পাহাড়। যে দুই পাহাড় ঘিরে হজরত ইবরাহিম (আ.) তার স্ত্রী হাজেরা (আ.) এবং তাদের পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর জীবনী রয়েছে।
আল্লাহর দরবারে হাজেরা (আ.) তৃষ্ণার্ত শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) পানি পান করানোর জন্য দোয়া করলে, আল্লাহ পাকের নির্দেশে জিবরাইল (আ.) পায়ের গোড়ালির মাধ্যমে কূপ খনন করেন। সে সময় থেকেই সৃষ্টি হয় জমজম কূপ।
পবিত্র কাবাঘর থেকে জমজম কূপের দূরত্ব মাত্র ৩৮ গজ। বর্তমানে সাফা-মারওয়া পাথুরে পাহাড় দুটো কেটে কাচের গ্লাস দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। তবে এর গুরুত্ব অসীম। হজ ও ওমরাহ পালন করতে হলে এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সায়ী করতে হয়। সীমানা বৃদ্ধি করায় সাফা-মারওয়া এখন হারাম শরিফের মক্কা মসজিদের ভেতরেই পড়েছে। ঐতিহাসিক জমজমের কূপ এখন আর উম্মুক্ত নয়। তবে এর পানি পানের যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে।
হারাম শরিফের সামনেই রয়েছে কবুতরের মাঠ নামক একটি জায়গা। কিন্তু এটা কোনো মাঠ নয়, চলাচলের প্রশস্ত সড়ক। সম্ভবত বাংলাদেশিরাই এর নামকরণ করেছে। সেখানে রয়েছে হাজার হাজার জালালি কবুতর। খুবই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। বহু দর্শনার্থী নিজ খরচে খাবার কিনে অবিরাম বিলিয়ে দেয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা, চলে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতরের আসা যাওয়া। এক কথায় অসাধারণ এক দৃশ্য।
মক্কা নগরীতেই রয়েছে জাবালে সাওর পর্বত। নবীজি হজরত আবু বকর (রা.)কে নিয়ে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের সময় এ পর্বতের গুহার ভেতরে আত্মগোপন করেছিলেন। এখন পর্যটকদের প্রজেক্টরের মাধ্যমে সাওর পর্বতের দৃশ্যাবলি দেখানো হয়।
ইচ্ছা করলে অফিস কক্ষ থেকে বিনামূল্যে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে সিডি নিয়ে আসতে পারেন। আর যদি আপনি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হয়ে থাকেন তাহলে পর্বত ভ্রমণ করে দেখে আসতে পারেন।‘ওগো সৃষ্টিকর্তা, আশ্রয়দাতা, রিজিকদাতা। জীবনে একবার হলেও হজ করার এবং এই ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখার তাওফিক দান করুন।’
সূত্র : মুসলিম মেমো, ডেইলি আগ, ডেইলি সাহারা