৬১ বছর পর আ’লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে ছিটকে গেল কিশোরগঞ্জ !!
১৯৬৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা ৬১ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে কিশোরগঞ্জের রাজনীতিকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
মহান ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুর্দিন-দুঃসময়ে দলটির কাণ্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন কিশোরগঞ্জের কৃতী সন্তান মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠপুত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ ঐহিত্যবাহী সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
এবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে ছিটকে যাওয়ার আগে মন্ত্রিত্ব থেকেও বঞ্চিত হয় কিশোরগঞ্জবাসী।ত্যাগ, বিশ্বাস, আস্থা ও অবদানের জায়গা থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি তাদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারে কিশোরগঞ্জে রাজনীতিকরা ঠাঁই করে নেন।
এ মাটির সন্তান প্রয়াত আসাদুজ্জামান খান বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব এবং মনোরঞ্জন ধর দলের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।কিশোরগঞ্জের সন্তান আবদুল হামিদ দীর্ঘ ৩৭ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বপালন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরোধী দলের উপনেতা, ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকারের দায়িত্বপালন শেষে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে গুরু দায়িত্বপালন করছেন।
কিন্তু ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২১তম কাউন্সিল শেষে ঘোষিত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটিতে কিশোরগঞ্জের কোনো রাজনীতিকের ঠাঁই হয়নি।
আওয়ামী লীগের ৭০ বছরের রাজনীতির ৬১ বছরজুড়েই ছিল কিশোরগঞ্জের রাজনীতিকদের পদচারণা ও দাপট। বলতে গেলে দলটির সুরক্ষা বেষ্টনী হয়ে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন তারা। দীর্ঘ ৬১ বছর পর ২১তম কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি থেকে ছিটকে পড়েছে কিশোরগঞ্জের রাজনীতিকদের নেতৃত্ব।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগ আন্তঃপ্রাণ কিশোরগঞ্জবাসীর মধ্যে চলছে অন্তহীন আলোচনা-সমালোচনা ও গুঞ্জন। দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে হাট-বাজার ও চায়ের দোকান পর্যন্ত সবার মুখে মুখে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও গুঞ্জনের অন্ত নেই।
তবে, এ নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করা তো দূরের কথা, তারা নাম-পরিচয় পর্যন্ত ব্যবহারে আপত্তি জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তাদের আস্থা। তিনি যেভাবে যা করছেন, তা দলের মঙ্গল চিন্তা করেই করছেন।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের কৃতী সন্তান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৫৭ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রাবন্ধিক আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মনসুর আহমেদের সঙ্গে কাউন্সিলে প্রতিযোগিতা করে তদানীন্তন অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এ মাটির সন্তান শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় গঠিত মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং উপদেষ্টা মনোনীত হন কিশোরগঞ্জের দুই কৃতী সন্তান।১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কয়েকদিনের মধ্যেই তার নেতৃত্বে সংসদীয় সরকার গঠিত হয়। এ সরকারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্পমন্ত্রী ও মনোরঞ্জন ধর আইনমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকারে দায়িত্বপালন করেন। সরকার গঠনের অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু দলের পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন।
ওই বছরের ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। সমবেত কাউন্সিলদের সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি এবং কিশোরগঞ্জের দুই কৃতী সন্তান সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ-সভাপতি ও জিল্লুর রহমান প্রথমবারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।এর আগে জিল্লুর রহমান ১৯৫৬ সালে তদানীন্তন কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠিত হলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাকশালের সহ-সভাপতি এবং জিল্লুর রহমান অন্যতম যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। পরবর্তীকালে জিল্লুর রহমান দীর্ঘদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন শেষে দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
তার মৃত্যুর পর কিশোরগঞ্জের অপর কৃতী সন্তান সাবেক স্পিকার আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।পিতার মৃত্যুর পর শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে লন্ডনে দীর্ঘদিন প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফেরেন। তিনি পিতার আসন কিশোরগঞ্জ সদর থেকে তিন তিনবার আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগের ১৯তম কাউন্সিলে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এ ছাড়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের মুখপাত্র, প্রেসিডিয়াম সদস্য হন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী, এলজিআরডি মন্ত্রী ও জনপ্রশাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বাস, আস্থা, ত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বারবার কিশোরগঞ্জের এ সব কৃতী সন্তানরা আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
এ মাটির অপর কৃতী সন্তান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আলাউদ্দিন আহমেদকে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত করা হলেও কোনো সান্তনা খুঁজে পাচ্ছে না কিশোরগঞ্জবাসী।
সূত্রঃ যুগান্তর