ঢাকার ৮০৪টি বাড়ি লকডাউন, করোনার আঘাত ৫৭ জেলায় !!
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলতি মাসে রাজধানীর ৮০৪টি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। বাড়িগুলো ৪১টি থানার ২২১টি এলাকায় অবস্থিত।এ ছাড়া চকবাজার থানার ১টি হাসপাতাল, কোতোয়ালি থানার গোয়ালনগর ও জিন্দাবাহার ৩নং গলি সম্পূর্ণ এলাকা, কোতোয়ালি থানা ব্যারাক, লালবাগ ধানার মেন্টার গলি পুরো এলাকা, মোহাম্মদপুর থানার ৬/৩ স্যার সৈয়দ রোডের কয়েকটি বাড়ি, ১৭১/৮ গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার এবং কামরাঙ্গীরচরের আবু সাঈদের ভিটার পুরো এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরপরই এসব বাড়ি ও এলাকা লকডাউন করা হয়েছে।স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) পর্যন্ত ৫৭টিতে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২১ জেলায় সংক্রমণ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া লোকজনের মাধ্যমে। আর নারায়ণগঞ্জে সংক্রমণ হয়েছে ইতালি ফেরত প্রবাসীর মাধ্যমে। এ ছাড়া আ’ক্রান্ত অন্য জেলার মধ্যে কয়েকটিতে সংক্রমণ হয়েছে ঢাকা ও গাজীপুর থেকে যাওয়া করোনা রোগীর মাধ্যমে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে, বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম তিনজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এই তিনজনের দু’জন ইতালি থেকে দেশে এসেছিলেন। তাদের মাধ্যমেই তৃতীয় ব্যক্তির সংক্রমণ হয়। এই তিনজনই নারায়ণগঞ্জের। এর পরই ঢাকা মহানগরীতে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। সেই থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের ৫৭ জেলায় করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি, বরিশাল বিভাগের ভোলা, রাজশাহী বিভাগের নাটোর এবং খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও মেহেরপুরে করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি।
সূত্র জানায়, লকডাউন করা বাড়িগুলো যেসব এলাকায় অবস্থিত, সেগুলো হচ্ছে : রাজধানীর হাজারীবাগ ধানার ৯টি এলাকা, নিউমার্কেট থানার একটি, রমনা থানার ৪টি, কলাবাগান থানার ৫টি, ধামনণ্ডি ধানার একটি, লালবাগ থানার ১৫টি, চকবাজার থানার ৬টি, কোতোয়ালি থানার ১৯টি, সূত্রাপুর থানার ১২টি, কামরাঙ্গীরচর থানার একটি, বংশাল থানার ৫টি, ওয়ারী থানার ১৩টি, যাত্রাবাড়ী থানার ১৮টি, কদমতলী এলাকার ৪টি, শ্যামপুর থানার ৬টি, গেণ্ডারিয়া থানার ১০টি, ডেমরার ৪টি, মতিঝিলের ৩টি, সবুজবাগের ৩টি, পল্টনের দুটি, মুগদার ৪টি, খিলগাঁওয়ের ৩টি, শাহজাহানপুরের ৭টি, হাতিরঝিলের ২টি, তেজগাঁওয়ের ২টি, আদাবরের ২টি, মোহাম্মদপুরের ৬টি, তেজগাঁও শিল্প এলাকার ৩টি, মিরপুরের ১৪টি, দারুসসালামের ৪টি, কাফরুলে ৩টি, রূপনগরের ২টি, পল্লবীর ৬টি, শাহআলীর ১টি, বাড্ডার ১০টি, ভাটারার ১টি, গুলশানের ২টি, খিলক্ষেতে ১টি, উত্তরা পুব-এর একটি, উত্তরা পশ্চিম-এর ৪টি এবং তুরাগ থানার একটি এলাকা।
নারায়ণগঞ্জ থেকে যেভাবে বিস্তার : টাঙ্গাইলে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ এপ্রিল। ৪৭ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির বাড়ি মির্জাপুর উপজেলার বৈরাগী ভাওড়া পশ্চিমপাড়া এলাকায়। শনাক্ত হওয়ার তিন দিন আগে তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে মির্জাপুরের বাড়িতে যান। লোকটি নারায়ণগঞ্জে একটি ক্লিনিকে চাকরি করতেন।গত ১৯ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে জেলার প্রথম করোনাভাইরাস আ’ক্রান্ত শনাক্ত হয়। তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে উপসর্গ নিয়ে নিজের এলাকায় যান। পরে তার নমুনা সংগ্রহ করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পাঠানো হলে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ব্যক্তির মাধ্যমে হবিগঞ্জ জেলায় সংক্রমণ হয়। ১১ এপ্রিল তার করোনা পজিটিভ হওয়ার তথ্য নিশ্চিত হয়। লালমনিরহাটে প্রথম করোনা পজিটিভ হয় সদর উপজেলায় গোকুণ্ডা ইউনিয়নের গুড়িয়া দহগ্রামের এক বাসিন্দার। তিনি নারায়ণগঞ্জে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। শনাক্ত হওয়ার তিন দিন আগে ৮ এপ্রিল তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসেন। তার করোনার উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা সংগ্রহ করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
দিনাজপুর জেলায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১৪ এপ্রিল। একইদিন জেলার তিনটি উপজেলার ৭ জন করোনা শনাক্ত হয়। চাঁদপুরে প্রথম করোনা আ’ক্রান্ত ব্যক্তিটি নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া। ওই ব্যক্তি করোনা উপসর্গ নিয়ে লকডাউনের মধ্যে ৫ এপ্রিল নৌপথে চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানায় শ্বশুরবাড়িতে যান।
পরে শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হলে ৯ এপ্রিল তার করোনা শনাক্ত হয়। পিরোজপুরে প্রথম করোনা পজিটিভ পাওয়া যায় মঠবাড়িয়ার এক ব্যক্তির। লকডাউনের মধ্যে তিনি ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে পিরোজপুর যান। ফরিদপুর প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১২ এপ্রিল। আ’ক্রান্ত ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া। তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে ফরিদপুরের নগরকান্দা গেলে তার করোনা উপসর্গ দেখা দেয়। পরে পরীক্ষার পজিটিভ আসে।
পাবনায় প্রথম করোনাভাইরাসে আ’ক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১৬ এপ্রিল। ৩২ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় টাইলস মিস্ত্রির কাজ করতেন। ওই ব্যক্তি ৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে পাবনায় গ্রামের বাড়িতে এসে জ্বর, ঠাণ্ডায় আ’ক্রান্ত হন।
নরসিংদীতে প্রথম করোনা চিহ্নিত ব্যক্তির বাড়ি জেলার পলাশ উপজেলার ইসলামপাড়া গ্রামে। মুফতি শামীম মিয়া নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। তিনি ওই গার্মেন্টের মসজিদে ইমামতিও করতেন। করোনা উপসর্গ দেখা দিলে তিনি নিজেই ৫ এপ্রিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা করান। পরদিন করোনা পজিটিভ জানতে পারেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ২০ এপ্রিল।
জেলা শহরের পৌর এলাকার দক্ষিণ চরমোহনপুর এলাকার ওই ব্যক্তি ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে এলাকায় আসেন। ওই সময় তার কোনো উপসর্গ ছিল না। তবে, নারায়ণগঞ্জ ফেরত হওয়ায় ওইদিনই তার নমুনা সংগ্রহ করে রাজশাহী পাঠানো হলে পজিটিভ আসে। বান্দরবানে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ১৫ এপ্রিল।
জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোনারপাড়া এলাকার ওই বাসিন্দা কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাবলিগ করে আসেন। আ’ক্রান্ত ওই ব্যক্তির বয়স ৫৯ বছর। রংপুরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার এক যুবকের। রংপুর মেডিকেলে নমুনা পরীক্ষা করলে গত ৮ এপ্রিল তার করোনা পজিটিভ হয়। এর আগে ওই যুবক নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
ঠাকুরগাঁওয়ে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১১ এপ্রিল। এ জেলায় একই দিনে তিনজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এদের মধ্যে দু’জনের বাড়ি হরিপুর উপজেলার। অন্য একজনের বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলায়। নড়াইল জেলায় প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ১৩ এপ্রিল। জেলার লোহাগড়া উপজেলায় শনাক্ত হওয়া ওই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জে বসবাস করতেন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতেন।
পটুয়াখালীতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৯ এপ্রিল। বরিশাল বিভাগের মধ্যেও এটি প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনা রোগী। তিনি নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করতেন। করোনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার আগে তিনি মারা যান।ঝালকাঠিতে ১২ এপ্রিল প্রথম তিনজনের করোনা শনাক্ত হয়। তারা তিনজনই একই পরিবারের। স্বামী-স্ত্রী ও তাদের শিশুসন্তান। সম্প্রতি তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঝালকাঠি যান।
নওগাঁর প্রথম করোনা আ’ক্রান্ত ব্যক্তিও নারায়ণগঞ্জ ফেরত। আত্রাই উপজেলার এই বাসিন্দার ২০ এপ্রিল কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে। এ ব্যক্তি গত ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি আসেন। পরে পরীক্ষার ফলাফলে তার নাম নিয়ে বিভ্রান্তি হওয়ায় আবারও পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয়।
রাজশাহী জেলায় প্রথম করোনা আ’ক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১২ এপ্রিল। তার বাড়ি পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া বগুড়াপাড়ায়। কয়েকদিন আগে ওই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি ট্রাকে করে রাতের আঁধারে বাড়ি ফেরেন। জয়পুরহাটে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ১৪ এপ্রিল।ওইদিন জেলার দু’জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। আ’ক্রান্তদের বাড়ি জেলার কালাই উপজেলায়। আ’ক্রান্তরা সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ থেকে সেখানে যান। গাজীপুর জেলার প্রথম করোনা রোগীও নারায়ণগঞ্জ থেকে সংক্রমিত হয়েছেন।
অন্যান্য জেলার প্রথম আ’ক্রান্তের মধ্যে পঞ্চগড়, জামালপুর, লক্ষ্মীপুর, কুড়িগ্রাম ও ফেনীতে ঢাকা থেকে যাওয়া লোকজনের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি জেলায় আ’ক্রান্ত হয়েছে প্রবাসীদের মাধ্যমে। কয়েকটি হয়েছে গাজীপুর থেকে। এর বাইরে অন্য জেলার সংক্রমণের উৎস নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের সব জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। এ সময় বেশিরভাগ জেলা থেকেই তাদের এলাকায় করোনা ছড়ানোর জন্য ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জকে দায়ী করা হয়।
আইইডিসিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২১ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় ঢাকা বিভাগে আ’ক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৪৫২ জন। এ বিভাগটিতেও আ’ক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক। আর করোনার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগে। মোট আ’ক্রান্তের ৭২.৫ শতাংশই এ বিভাগে।
ঢাকা বিভাগের আ’ক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে এক হাজার ২২৯ জন (৩৬.৩৪ শতাংশ) এবং জেলাগুলোয় এক হাজার ২২৩ জন (৩৬.১৬ শতাংশ)। এ ছাড়া অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ১২৫ জন (৩.৭০ শতাংশ), সিলেট বিভাগে ১৮ জন (০.৫৩ শতাংশ), রংপুর বিভাগে ৫২ জন (১.৫৪ শতাংশ), খুলনা বিভাগে ৯ জন (০.২৭ শতাংশ), ময়মনসিংহ বিভাগে ৯৯ জন (২.৯৩ শতাংশ), বরিশাল বিভাগে ৬৫ জন (১.৯২ শতাংশ) এবং রাজশাহী বিভাগে ২১ জন (০.৬২ শতাংশ)।