লিবিয়া পাচারকারী চক্রের সন্ধানে নেমেছে সিআইডি !!
লিবিয়ায় দুষ্কৃতকারীদের গু’লিতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১১ জন আহতের ঘটনায় ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) তদন্তে নেমেছে। বাংলাদেশি পাচারকারী চক্রের কয়েকজনকে চিহ্নিত করে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। চক্রের মূল হোতা দু’জন এ মুহূর্তে দেশে নেই। তবে তাদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এদিকে, লিবিয়ায় দুষ্কৃতকারীদের গু’লিতে নিহত ও আহতদের গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
শনিবার বিকালে সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, টেলিফোনে আহত ও নিহতদের পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাশাপাশি চিহ্নিত বাংলাদেশি দালালদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের পর থেকে লিবিয়াতে বাংলাদেশি শ্রমবাজার বন্ধ আছে। বৈধভাবে সেখানে শ্রমিক যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দালালদের খপ্পরে পড়ে হতাহতরা অবৈধভাবে সেখানে গেছেন। প্রথমে তাদের ভারতে নেয়া হয়। সেখান থেকে দুবাই হয়ে তাদের লিবিয়ায় নেয়া হয়। এরপর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তাদের ইতালিতে নেয়ার কথা ছিল। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের মানব পাচারকারী চক্র জড়িত। চক্রের সদস্যদের অধীনে ৩৮ বাংলাদেশি ও কয়েকজন সুদানিকে লিবিয়ার বেনগাজী থেকে উপকূলীয় অঞ্চল যুওয়ারা নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু পথিমধ্যে মিজদাহ এলাকায় অপহরণকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত মাত্র শুরু হয়েছে। এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। নিহতদের পরিবারের সদস্য, আহত এবং দালালদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
লিবিয়ায় বাংলাদেশি হ’ত্যায় বিসিএসএমের উদ্বেগ প্রকাশ : লিবিয়ার মিজদা অঞ্চলে ২৬ বাংলাদেশি হ’ত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম) গভীরভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে। শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি সন্দেহভাজন খুনিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করায় লিবিয়ার সরকারকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী, মানব চোরাকারবারি এবং তাদের বাংলাদেশি সহযোগীরা ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের পাচার করছে।
‘ছেলের লা’শটা যেন পাই’ : যশোর ব্যুরো জানায়, লিবিয়ায় নিহতদের মধ্যে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামের ইসরাফিল হোসেনের ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিব (২০) রয়েছেন। তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম চলছে। রাকিবের মা মাহিরুন নেছা বলেন, ‘ভিটেবাড়ি বেঁচে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে রাস্তাতেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমার সোনারে বাঁচতে দিল না। আমাগের আর ছাদের বাড়ি করা লাগবে না, তুই ফিরে আয় বাজান; ফিরে আয়! আমার সোনারে আমার কাছে আনি দেন।’ ছেলেকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছেন ইসরাফিল হোসেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, জমি বিক্রি ও জমানো সাড়ে চার লাখ টাকায় দালালের মাধ্যমে ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠান। লিবিয়ার একটি শহরে রাকিবকে আটকে রেখে দালাল চক্র নির্যাতন শুরু করে। মোবাইল ফোনে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা দিতে রাজিও হন। এরই মধ্যে রাকিবুলকে গু’লি করে হ’ত্যা করা হয়েছে।
ভৈরবের ৬ যুবকের ইতালিতে যাওয়া হল না : ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, লিবিয়ায় ভৈরবের ছয়জন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- আকাশ (২৬), রাজন (২৭), সাকিব (২৩), মোহাম্মদ আলী (২৫), মাহাবুবুর রহমান (২১), মামুন (২৪)। তাদের আর স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাওয়া হল না। কেউ ৫ মাস, কেউ ৮ মাস আবার কেউ ১ বছর লিবিয়ায় অবস্থান করার পরও ইতালিতে যেতে পারেননি। এরপর বাংলাদেশ থেকে আরও টাকা আনতে তাদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়।
নিহত আকাশের বড় ভাই মোবারক জানান, স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে আকাশ লিবিয়ায় পাড়ি জমান। বুধবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে মেসেজ আসে ‘আমাকে বাঁচাও। ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে আমাকে মেরে ফেলবে।’ এরপর থেকে তার আর খোঁজ মিলছিল না। নিহত সোহাগের মা কাজলি বেগম বলেন, ‘কথা ছিল লিবিয়ায় যাওয়ার পর সাগরপথে তাকে ইতালি পৌঁছে দেবে দালালরা। কিন্তু এখন লা’শের খবর পেলাম।’
ফরিদপুরে কামরুলের বাড়িতে শোকের মাতম : ফরিদপুর ব্যুরো জানান, লিবিয়ায় নিহতদের মধ্যে সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামের কবির শেখের ছেলে মো. কামরুল শেখ (২৪) রয়েছেন। তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। কামরুলের বড়ভাই মো. ফারুক শেখ জানান, ৫ মাস আগে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার এক দালালের মাধ্যমে কামরুল লিবিয়ায় যান। এরপর বৃহস্পতিবার জানতে পারেন লিবিয়ায় কামরুল নিহত হয়েছেন।
মাদারীপুরে স্বজনদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে : টেকেরহাট (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, লিবিয়ায় নিহতদের মধ্যে মাদারীপুর সদর, রাজৈর ও পাশের গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায় নিখোঁজ, নিহত ও আহতের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। হোসেনপুর বিদ্যানন্দী গ্রামের নিখোঁজ মানিক হাওলাদারের বাবা শাহ আলম হাওলাদার বলেন, মানিককে লিবিয়া নেয়ার কথা বলে দালাল জুলহাস প্রথমে ৪ লাখ টাকা নিয়েছে। পরে ছেলেকে বেনগাজী আটকে রেখে মোবাইল ফোনে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। জুলহাসের বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসি। কিন্তু এখনও ছেলের খোঁজ পাচ্ছি না।
১০ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় মাগুরার যুবক খুন : মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি জানান, লিবিয়ায় মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার নারাণপুর গ্রামের লাল চাঁদ (২৫) লিবিয়ায় নিহত হয়েছেন। তার সঙ্গে যাওয়া একই গ্রামের ফুল মিয়ার ছেলে তরিকুল ইসলাম (২০) হাতে গু’লিবিদ্ধ হয়েছেন। লিবিয়ার একটি হাসপাতালে তরিকুল চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নিহত লাল চাঁদের পিতা ইউসুফ আলী জানান, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে লিবিয়ায় যায় লাল চাঁদ। ঈদুল ফিতরের ২ দিন আগে ফোন আসে ১০ লাখ টাকা না দিলে তাকে ছাড়া হবে না। পরে খবর আসে তাকে গু’লি করে মেরে ফেলা হয়েছে।
সূত্র- যুগান্তর