একটি হ’ত্যাকাণ্ডে পাল্টে গেল মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র !!

এইতো কদিন হলো ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানাতে থার্টি ফার্স্ট নাইটে মেতেছিল গোটাবিশ্ব। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যই হলো বছরটি যেন ভালো যায়। নাচ-গান আর হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে এই অভ্যর্থনার মাত্র দুদিন পার হয়েছে। তিন দিন পড়তেই শোনা গেল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের অভিজাত বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) কুদস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানি নিহত হয়েছেন। এই একটি মাত্র হ’ত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ব রাজনীতি তো বটেই, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এর ছায়া পড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সোলাইমানি হ’ত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র পাল্টে গেল। এ হ’ত্যাকাণ্ড ট্রাম্পকে স্বস্তি দিলেও মধ্যপ্রাচ্যে রক্ত ঝরাবে।

এ হামলার উপযুক্ত জবাব দিতে মরিয়া হয়ে উঠবে ইরান; যা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য চরম অস্বস্তির কারণ হবে। ইতোমধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ‘কঠিন প্রতিশোধের’ ঘোষণা দিয়েছেন। ইরানের প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড ঘিরে বদলে যেতে পারে ‘বিশ্ব রাজনীতির ভরকেন্দ্র’ মধ্যপ্রাচ্যের আগামীর দিনগুলো।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের মতে, যে হাতে মার্কিনিদের রক্ত ঝরেছে, তার মৃত্যু ইরানি শাসনের ওপর একটি বড় আঘাত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সোলাইমানিকে হ’ত্যার মধ্য দিয়ে বদলে যেতে পারে ইরাকসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ। ইরানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামিক জিহাদ, পাকিস্তানে ফাতেমিয়ুন এবং আফগানিস্তানে জাইনাবিয়ুন, ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী ও মিলিশিয়া বাহিনীগুলো। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের অবস্থানে আঘাত হানতে মরিয়া হয়ে উঠবে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী।

সোলাইমানিকে হ’ত্যা ইরানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সৌদি আরবের জন্যও আনন্দদায়ক হবে নিঃসন্দেহে। এ ঘটনাকে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেলক্ষেত্রে হামলার ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবেই কল্পনা করে আপাতত তৃপ্ত হবে তারা। তবে হুথি গোষ্ঠী ইয়েমেন ও সীমান্ত এলাকায় সৌদি আরবকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। সম্প্রতি তাদের বেশ কয়েকটি হামলা অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। এ ঘটনার পর তারা আরও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে। কেননা ইয়েমেন যুদ্ধে মার্কিন-সমর্থিত সৌদি জোটকে ব্যর্থতার মুখে ফেলতে এই হুথিদের সমর্থনে কাজ করেছে কুদস বাহিনী।

সোলাইমানির ওপর হামলাকে এই অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন আলজাজিরার বিশ্লেষক ওসামা বিন জাভেদ। তিনি বলছেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাগদাদের সম্পর্কের বড় ধরনের অবনতি ঘটবে। এখন সোলাইমানিকে হ’ত্যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো স্বার্থই বাধার মুখে পড়বে।

সোলাইমানিকে হ’ত্যা ইরানের বিরুদ্ধে এক প্রকার ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে মনে করছেন হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক প্রাক্তন কর্মকর্তা হিলারি মান লেভেরেট। তিনি বলেছেন, সোলাইমানি হ’ত্যা মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বা মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধানকে হ’ত্যার শামিল।

ওয়াশিংটন দাবি করেছে, ভবিষ্যতে ইরানের হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করতেই ট্রাম্পের নির্দেশে জেনারেল সোলাইমানিকে হ’ত্যা করা হয়েছে। পেন্টাগনের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যেকোনো স্থানে তার লোকজন ও স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে।

তবে এই হ’ত্যাকাণ্ড-পরবর্তী পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের উপস্থিতি এখন অবিশ্বাস্যভাবে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়বে বলে মনে করছেন হিলারি মান।

ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে সোলাইমানিকে হ’ত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউস। তবে মার্কিন কংগ্রেসে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন হিলারি মান। মার্কিন অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে এই হ’ত্যাকাণ্ডকে অবৈধ কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করেছেন তিনি।

সোলাইমানির হ’ত্যাকাণ্ডে ইরাকে ইরানি হস্তক্ষেপ আরও বেশি প্রবল হতে পারে। ইরাকে শিয়াপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সমন্বিত সংগঠন পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ) গঠিত হয়েছে কুদস বাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে। সোলাইমানির শোকে এই সংগঠন আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

মার্কিন সিনেটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য সিনেটর ক্রিস মারফি সতর্ক করেছেন, এই হ’ত্যাকাণ্ড বিশাল একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

১৯৮০-র দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন করার সময় পরিচিত হয়ে ওঠেন জেনারেল সোলাইমানি। ১৯৯৮ সাল থেকে ইরানের কুদস বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো শক্তির জন্য আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল কুদস বাহিনী।

ইরানের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও গত কয়েক বছরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ইরাকে ইসলামিক স্টেট-আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ৬২ বছর বয়সী এই সামরিক কমান্ডার।

ইতোমধ্যে জেনারেল সোলাইমানি হ’ত্যাকাণ্ডে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ।

মধ্যপ্রাচ্যে যাবতীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন তিনি। এই হ’ত্যাকাণ্ডকে আল-কায়েদা, আইএস, আল-নুসরাহর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের চরম বিপজ্জনক ও বোকামিপূর্ণ অভিযান বলে মন্তব্য করেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

আলজাজিরার দোরসা জাব্বারি তেহরান থেকে জানান, সোলাইমানির হ’ত্যাকাণ্ড শুধু ইরানে নয়; মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় ধরনের ধাক্কা ও বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে এই মুহূর্তে সোলাইমানির মৃত্যু বড় ধরনের ক্ষতি ইরানের জন্য। সোলাইমানির পদে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কানিকে।

এদিকে হ’ত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সর্বোচ্চ প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি বলেছেন, যেসব অপরাধী তাদের নোংরা হাত দিয়ে গতরাতে জেনারেল সোলেইমানির রক্ত ঝরিয়েছে তাদের জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *