ওসি’র উদ্যোগে দেশে ফিরল ভারতে পাচার হওয়া কিশোরী !!

অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া কিশোরীকে উদ্ধার করেছে কুতুবদিয়া থানার ওসি মো. দিদারুল ফেরদাউস। ঘটনার সূত্রে ওসি বলেন, গত ২০১৯ সালের জুলাই মাস। ওইদিন ১১ তারিখ ছিল। বিদেশের একটি ফোন নম্বর থেকে অফিসার ইনচার্জ কুতুবদিয়া থানার সরকারি মোবাইলে কল আসল।

কান্ট্রি কোড দেখে বুঝে নিলাম ফোন নম্বরটি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের। সরকারি ফোনে সচরাচর এমন কল না আসায় একটু অবাকই হলাম। একরকম বিস্ময়চিত্তে রিসিভ করে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে এক ভরাট কণ্ঠের ভদ্রলোক হিন্দি ভাষায় আমি অফিসার ইনচার্জ, কুতুবদিয়া কিনা জিজ্ঞেস করলেন।

জাতিসংঘ মিশনে থাকাকালে ভারতীয়দের সঙ্গে কাজ করার সুবাধে উনার সঙ্গে কথা বলতে খুব একটা সমস্যা হলো না। তারপর তিনি যা জানালেন তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শোনার পর আমার মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। তিনি জানালেন আসমা বেগম নামের এক কিশোরী যার বাড়ি কুতুবদিয়ায়, আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের শিকার হয়ে বিভিন্ন হাত ঘুরে আরো কিছু কিশোরীর সঙ্গে ট্রেনে করে ভরতের গুজরাটের আহমেদাবাদ যাচ্ছে।

কিশোরীদের দেখে লোকটির সন্দেহ হয়, তাই তিনি কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলে এবং জানতে পারে কিশোরীর বাড়ি বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায়, সে চট্টগ্রাম থেকে মানবপাচারের শিকার হয়েছে। আমি তাৎক্ষণিক লোকটিকে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানায় জানাতে বলি। আমার পরামর্শ মতো লোকটি এই বিষয়ে থানায় জানালে ভারতের আদালাজ থানার পুলিশ সদস্যরা পাচার যাত্রায় আসমাসহ ৮ জন কিশোরীকে উদ্ধার করে স্থানীয় (Children Home For Girls, Odhav, Ahmedabad, Gujrat) নামক শিশু আশ্রমে স্থানান্তর করে।

এদিকে আমি মেয়েটির মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তার মা বাবা জানায়, সাড়ে পাঁচ মাস আগে চাকরিতে যোগদানের জন্য সে কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে চলে যায়। এরপর মা-বাবার সঙ্গে খুব কমই কথা হতো। কিন্তু ১৫ দিনে আগে হঠাৎ করে আসমা ফোন করে তার মা-বাবাকে বলে আমার আশা করো না, আমার জন্য দোয়া করো’। মেয়ের মা-বাবার কাছ থেকে এসব শোনার পর যখনই কিছুটা আশাহত হলো ঠিক তখনই আশার আলো দেখালেন ডা. হার্ষা আগারওয়াল।

যিনি আহমেদাবাদের শিশু আশ্রমে সাইকোলজিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ডা. আগারওয়ালের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কথা হলো, বিস্তারিত আলাপকালে তিনি মেয়েটিকে কিভাবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যায় সে ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা চাইলেন আর আমি উনাকে আশ্বস্ত করলাম যে মেয়েটিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমাদের চেষ্টার কমতি থাকবে না।

এরপর আমি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ-খবর নিয়ে যোগাযোগ করলাম ‘রাইটস যশোর’ নামের এক এনজিও’র অন্যতম কর্ণধার বিনয় কৃষ্ণ মল্লিকের সঙ্গে। উনারা মানবপাচারের শিকার হওয়া লোকদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কাজ করেন। তিনি জানালেন মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠান সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এরপর শুরু হলো আসমা নামের কুতুবদিয়ার মেয়েটিকে তার মাতৃকোলে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের কর্মযজ্ঞ।

যোগাযোগ করা হলো ভারতে অবস্থিত কনস্যুলেটের সঙ্গে তারা কথা বললেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। আসমাসহ বাংলাদেশের তিনজন মেয়ের পরিচয় এবং তাদের অতীত বর্তমান জানার জন্য শুরু হলো গোয়েন্দা তৎপরতা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখায় আসমার আইনগত প্রত্যাবাসনের জন্য তার নাম-ঠিকানা, প্রাক-পরিচিতি এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে গোপন প্রতিবেদন চাওয়া হয়। এতসবের মাঝেও ডা. হার্ষা আগারওয়াল আর বিনয় মল্লিকের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল।

আমরা আসমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে অবহিত করতাম। গত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে পুলিশ সুপার, জেলা বিশেষ শাখা, কক্সবাজারের মাধ্যমে কুতুবদিয়া থানা আসমা এবং তার পরিবার সম্পর্কে তথ্য প্রেরণের একটি আদেশ পাই। কুতুবদিয়া থানা পুলিশ যেহেতু আগে থেকেই এ বিষয়ে অবগত আছে এবং আমাদের পরোক্ষ সহায়তায় এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তাই আমরা দেরি না করেই দ্রুত এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিলাম।

অবশেষে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষে আমাদের কষ্ট সফলতার মুখ দেখল। চলতি মাসের ১২ তারিখে আসমা দেশে ফিরে আসে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে বেনাপোল বন্দর থানায় হস্তান্তর করলে সেখান থেকে ‘রাইটস যশোর’ মেয়েটিকে জিম্মায় গ্রহণ করে আমাকে জানায়। আমি মেয়ের বাবা জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য যশোর পাঠিয়ে দেই। আজ মঙ্গলবার (১৬ জুন) দুপুর ১টার সময় জাহাঙ্গীর আলম তার মেয়ে আসমাকে নিয়ে কুতুবদিয়ায় ফিরে আসে।

আসমা বেগমের আত্মীয়-স্বজন আসমাকে ফিরে পেয়ে ঈদের আনন্দের মতো খুশিতে আত্মহারা। অবশ্য তারা কুতুবদিয়া দ্বীপের বাইরের থেকে আসায় আসমা ও তার বাবা জাহাঙ্গীর আলমকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। পুলিশ, স্থানীয় দক্ষিণ ধুরুং ইউপির চেয়ারম্যান ছৈয়দ আহমদ চৌধুরী, মেম্বার গ্রাম পুলিশ তাদের নিরাপত্তার বিষয় সার্বিক দেখভাল করছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *