তোমরা একে অপরকে ধোকা দিয়ো না, সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও – রাসুল (সা.)

আত্মার রোগসমূহের মাঝে অন্যতম একটি হচ্ছে হিংসা। হিংসুক হিংসার কারণে ভেতরে ভেতরে জ্ব’লতে থাকে। কারো কোনো গুণ তার সহ্য হয় না। এজন্য কারো ভালো কিছু দেখলেই তার শ’ত্রুতে পরিণত হয়।শ’ত্রুতা করাই হয় তার কাজ। ঠিক ইবলিস শয়তানের মত।

ইবলিস যখন আদমের গুণ দেখতে পেল তখনই সে তার শত্রু হয়ে গেল। হিংসা থেকেই সে বলল, আনা খাইরুম মিনহু। আমি তার চেয়ে ভালো। হে মাবুদ, তুমি তাকে আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছ? আমি তার বংশধরদের পথভ্রষ্ট করে ছাড়ব। (বানু ইসরাইল, আয়াত: ৬২)

হজরত আদম পৃথিবীতে আসলেন। তার সন্তানদের ভেতর শয়তানের এ পঁচা গুণটি সং’ক্রমিত হলো। কাবিল হিংসা করল হাবিলকে। হিংসায় জ্ব’লে নিজের ভাইকে হ’ত্যা করল। হিংসা এমন এক রোগ যা সুস্থ মানুষের মন বিগড়ে দিতে দেরি করে না। বিবেচনা বোধ একেবারে লোপ পায়। বিবেক বলে কিছু থাকে না হিংসুকের। নবীর সন্তান হয়েও হিংসার কারণে কী জঘন্য কর্ম করেছিল ইউসুফের (আ.) ভাইয়েরা।

‘তারা বলল, পিতার কাছে ইউসুফ ও তার ভাই আমাদের চেয়ে বেশি প্রিয়, অথচ আমরা একটি সংহত দল; আমাদের পিতা স্পষ্ট বিভ্রা’ন্তিতে আছে। তোমরা ইউসুফকে হ’ত্যা করো অথবা তাকে কোথাও ফেলে আস, ফলে তোমাদের পিতার দৃষ্টি শুধু তোমাদের প্রতিই নিবিষ্ট হবে, তারপর তোমরা ভালো মানুষ হয়ে যাবে।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৮-৯)

নিজেদের বৈমাত্রিয় ভাইকে হ’ত্যা করতে উদ্যত হয়েও তাদের নিজেদেরকে বিভ্রা’ন্ত মনে হয়নি। আর অপেক্ষাকৃত ছোট বলে ইউসুফ ও বিন ইয়ামিনকে অধিক আদর করেন বলে ইয়াকুবকে (আ.) বিভ্রা’ন্ত বলে ফেলল। ভাইকে হ’ত্যা করা বা গুম করা অ’পরা’ধ তা তারা বুঝতে পারছিল। কিন্তু নিজেদেরকে এই বলে বুঝ দিল যে, আমরা এই অন্যায় করার পর খুব ভালো মানুষ হয়ে যাব।

হিংসুক এমনই হয়। তার স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধি লোপ পায়। যে করে হোক অনিষ্ট সাধন করেই সে শান্ত হয়। এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হিংসুক থেকে আশ্রয় নিতে শিখিয়েছেন।

আল্লাহ ইরশাদ করেন, ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইযা হাসাদ। আর আমি প্রভাতের প্রভুর নিকট আশ্রয় নিচ্ছি হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে। (সুরা ফালাক) রাসুল (সা.) বলেন, খবরদার হিংসা থেকে বেঁ’চে থাক, হিংসা সব নেক আমল খেয়ে ফেলে, যেমন আ’গুন শুকনো ঘাস খেয়ে ফেলে। (আবু দাউদ)

সত্যি হিংসা আ’গুনের মতই হিংসুকের পেটের ভেতর জ্ব’লতে থাকে। হিংসুকের হিংসাকে পরোয়া না করলে সে আ’গুন হিংসুককেই জ্বা’লিয়ে সারখার করে দেয়। এ জন্য কেউ হিংসা করলে তাতে খুব বিচলিত হবার কিছু নেই। হিংসাকারী ভালো কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। সে শুধু নষ্ট করতে জানে। জ্বা’লাতে জানে। জ্বা’লানোর মত কিছু না থাকলে নিজের ভেতরেই জ্ব’লতে থাকে। তাকে জ্ব’লতে দেয়া উচিত। তুষের মত সে জ্ব’লুক।

বুযুর্গরা দোয়া করতেন, হে আল্লাহ, আমাকে যেন মানুষ হিংসা করে, আর আমি যেন কাউকে হিংসা না করি। এর অর্থ হচ্ছে আমাকে অনেক গুণের আধার বানাও, আমার গুণ দেখে যেন সবাই হিংসায় জ্ব’লে; আর আমার ভেতর কোনো অপূর্ণতা রেখ না, অপূর্ণতা থাকলেই তো আমি অন্যকে হিংসা করব।

আপনার ভেতর যখন গুণ থাকবে তখন লোকেরা আপনাকে হিংসা করবেই। এ নিয়ে আপনার এজন্য দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বরং কেউ হিংসা করলে আপনার খুশি হওয়া উচিত। যখন আপনার ভেতর কোনো গুণের অভাব থাকে তখনই আপনি অন্যের ভেতর সে গুণ দেখে তাকে হিংসা করবেন।

আরব কবি বলেন, একটা দিন কোনো হিংসুকের হিংসা থেকে মুক্ত থাকা খুবই মন্দ কথা। নিকৃষ্ট মানুষকেই কেউ হিংসা করে না। হে খোদা আমি যেন এমন নিকৃষ্ট না হই যে, আমাকে আর কেউ হিংসা করে না। সত্যি অযোগ্য অপদার্থ লোকদের কেউ হিংসা করতে যায় না।

প্রিয় পাঠক, এজন্য হিংসা না করে নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলুন যেন অন্যরা সবাই আপনাকে হিংসা করতে পারে। হিংসুটে না হয়ে হিংসার পাত্র হবার চেষ্টা করুন। রাসুল (সা.) বলেন, ইমান ও হিংসা কারো ভেতর একত্র হতে পারে না। (মুসলিম)অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ করো না, একে অপরকে ধোকা দিয়ো না, সম্পর্ক ছিন্ন করো না, হে আল্লাহর বান্দারা তোমরা সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও। (মুসলিম)

এবার বর্তমান সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন। মুসলিম সমাজে ইসলামের এ শিক্ষাগুলো কতটুকু আছে? অন্যদের দিকে না তাকিয়ে প্রত্যেকে যার যার অবস্থা যাচাই করুন। আমরা আজকাল সবাই কি একটু বেশিই হিংসুটে হয়ে যাচ্ছি না? কেন? এমন হিংসুটে ভাব কেন? অন্যের ভালোটা সইতে এত কষ্ট হয় কেন? তার কারণ হচ্ছে আমরা আর সত্যিকার মুসলিম নেই। ইমানের মূল মর্ম আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মগজহীন খোসা নিয়ে আছি আমরা।

ইমান নিয়ে কবরে যেতে হলে আমাদের স্বভাব পাল্টাতে হবে। বদলাতে হবে নিজেদেরকে। গুণীর গুণের স্বীকৃতি দেয়া শিখুন। কারো ভালো কিছু দেখে কষ্ট হলে কষ্ট ভেতরেই রাখুন। বাইরে যেন প্রকাশ না পায়। ভেতরে ভেতরে কিছুক্ষণ জ্ব’লুন। একসময় ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন।

নিজের চিকিৎসা নিজেকেই করতে হবে। নিজেকে গড়ার কাজ করলে এসব রোগ বাসা বাঁধতে পারে না। একজন ইমানদার কখনও অন্যের ভালো দেখে হিংসা করতে পারে না। অন্যের সুখে সুখী হওয়াই ইমানদারের লক্ষণ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সবাইকে হিংসার দোষ থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *