প্রবাসে সবচেয়ে কষ্ট লাগে প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শুনতে !!

আমার রাতের ডিউটি চলছে। প্রতিদিনের মতো অফিসে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প করছি। কাজ শুরুর নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা আগেই অফিসে পৌঁছে যাই। তাই গল্প করার সুযোগ পাওয়া যায়।

প্রবাসে কাজের ব্যস্ততা, পারিবারিক সমস্যা, শারীরিক অসুস্থতায় প্রায়ই প্রবাসীদের মন খারাপ থাকে। মনের মধ্যে অজানা শঙ্কা, ভয় নিয়ে আমাদের দিন পার করতে হয়। অফিসে এসে আমরা বাংলাদেশিরা একসাথে বসে একটু আড্ডা গল্পে মেতে উঠি। কাজ শুরু হবার আগ পর্যন্ত চলে এই আড্ডা।

অনেক সময় অল্প গল্প শুনেও সবাই হাসিতে ফেটে পড়ি। যখন আনন্দের অভাব হয় তখন মানুষ সামান্য কারণেও হাসে বা হাসার অভিনয় করে যায়। আবার অনেক সময় হাসির গল্পেও হাসি আসে না। মনে বেদনা পুঞ্জিভূত হলে তখন মস্তিষ্কে হাসি নিয়ন্ত্রিত অংশ সাবকর্টেক্স কাজ করে না।

আজকে আমাদের গল্প শুরু হয়, আরেক সহকর্মীকে নিয়ে। সে জিমে গিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিয়ে ক্যাপশনে লেখে, সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। তার ভাবখানা এমন যে সে প্রায়ই ব্যায়াম করে।অথচ সে ব্যায়াম না করে ছবি তুলেই বের হয়ে যায়। আমরা সেই ছবি দেখে একেকজন একেক কথা বলছি আর হাসাহাসি করছি। এমন সময় মতিউর ভাইয়ের মোবাইলে কল এলো।

তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটু দূরে সরে কল রিসিভ করে হ্যালো বললেন। এরপর তার মুখে আর কোনো কথা নেই। সে মোবাইল কানে দিয়েই দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাটিতে বসে পড়ল। তার চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে। সবাই হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি।

মুহূর্তে আনন্দময় পরিবেশে বিষাদে ছেয়ে গেলো। আমি উঠে গিয়ে তার পাশে বসে বললাম কি হইছে ভাই আপনি কাঁদছেন কেন? কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর সে বলল, ভাই আমার ছোট মেয়ে মইরা গেছে। সে আর কিছু বলতে পারল না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সবাই মতিউর ভাইকে ঘিরে বসে তাকে শান্তনা দিচ্ছে।

আমি তার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি মোবাইলে ওপাশে এখনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমি মোবাইলটা কানে দিয়ে বললাম, হ্যালো কে বলছেন? বাড়িতে কী হয়েছে? মতিউর ভাই কান্না করছে? তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলাম।

আশ্চর্য মোবাইলের ওপাশ থেকে আমার প্রশ্নের জবাবে কেউ কিছু বলছে না। শুধু বেদনাদায়ক কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। এমন বিষাদময় কান্না শুনে সহ্য করতে পারলাম না। মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মতিউর ভাইকে বললাম, আপনার বাড়ির কারও নম্বর দিন কথা বলি। এভাবে কান্না করে কি হবে ভাই। আপনি শান্ত হন। যদিও তাকে সান্তনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। প্রিয় সন্তান হারানোর বেদনায় পিতাকে কি বলে সান্তনা দিতে হয় তা আমার জানা নেই।

মতিউর ভাই তার চাচীর নম্বর দিলো। আমি সাথে সাথে আমার মোবাইল থেকে কল দিলাম। কয়েকবার রিং হবার পর একজন কল রিসিভ করে ওপাশ থেকে হ্যালো বলল। আমি বললাম, আমি মতিউর ভাইয়ের সহকর্মী বলছি। বাড়িতে কি হয়েছে আমাকে কি বলা যাবে?হ্যাঁ বাজান। আমাদের মতিউরের ছোট মাইয়া পানিত পইড়া মইরা গ্যাছে। তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। তিনিও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

কিছুক্ষণ পর আবার কল দিয়ে জানতে পারলাম। মতিউর ভাইয়ের ছোট মেয়ে যার বয়স মাত্র এক বছর। সবেমাত্র হাঁটা শিখেছে। সে নাকি অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে বাড়ির আঙিনায় খেলছিল। তার বউ অসুস্থ হওয়ায় বিছানায় শুয়ে ছিল। আধাঘণ্টা পর বাহিরে বের হয়ে তিনি অন্যান্য বাচ্চাদের দেখতে পান কিন্তু তার ছোট মেয়েকে দেখতে পান না। সাথে সাথে তিনি এদিক-ওদিক মেয়েকে খুঁজতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পান। যা দেখে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। একজন মায়ের পক্ষে এমন অবুঝ সন্তানের লাশ দেখার ক্ষমতা নাই।

মতিউর ভাই কান্না করছে। আর আমরা সবাই তাকে ঘিরে মন খারাপ করে বসে আছি। অনেকের চোখ ছলছল করছে। আমি তার কান্না সহ্য করতে না পেরে অন্যত্র চলে গেলাম।

কিছুক্ষণ পর আমাদের সিনিয়র সেফটি অফিসার সুব্রত ভাইকে কল দিলাম। তাকে বিস্তারিত জানানোর পর তিনি বললেন, মতিউর কি দেশে যাবে? হ্যাঁ ভাই দেশে গেলে তো ভালই। ঠিক আছে আমি মতিউর রহমানের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করতেছি।তিনি আর কথা বাড়ালেন না। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সাথে মতিউর ভাইকে কল দিলেন। সুব্রত ভাই মতিউরের সাথে কথা বলে তাকে সান্তনা দিয়ে আশ্বাস দিলেন তার দেশে যাবার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা তিনি করবেন।

প্রবাস থেকে ইচ্ছে করলেই দেশে যাওয়া যায় না। কোম্পানি ছুটি মঞ্জুর করলে বিমান টিকিট কিনতে হবে। তাছাড়া অনেক সময় বিমানের টিকিট পাওয়া যায়। টিকিট কেনার জন্য সাথে টাকাও তো থাকা চাই। অনেক প্রবাসীই বেতন পাবার পর নিজের খরচ বাবদ সামান্য টাকা রেখে সব টাকা দেশে আপনজনদের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

সুব্রত ভাই এইচআর ও বসদের সাথে আলোচনা করে মতিউরের ছুটি মঞ্জুর করালেন। শুধু তাই নয় পরের ফ্লাইটের বিমান টিকিটও অনলাইনে ক্রয় করে আমাকে কল দিয়ে বললেন, মতিউরের দেশে যাবার সব ব্যবস্থা করেছি। আপনি মতিউরের সাথে কথা বলে তাকে সান্তনা দিন। আর তাকে সকালে অফিসে আসতে বলুন আমি সকালে তার বিমান টিকিট ও ছুটির ব্যাপারে আনুষঙ্গিক কাজ সেরে দেব।

সকালে মতিউর অফিসে এলে তার চেহারার দিকে তাকাতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত সে প্রিয় সন্তান হারানোর বেদনায় সে সারারাত ঘুমায়নি। হয়ত সে সারারাত কেঁদেই পার করে দিয়েছে। সুব্রত ভাই মতিউর রহমানকে অফিসে ডেকে সান্তনা দিয়ে তার হাতে বিমান টিকিট ধরিয়ে দিলেন।

সুব্রত ভাইয়ের কথা শুনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান। তিনি যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। শুনে সত্যি আমি কৃতজ্ঞ হলাম। এর আগেও তিনি কয়েকবার এভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

মানুষ মানুষের জন্য। সুব্রত ভাইয়ের এই ভালো কাজ হয়ত আমরা মনে রাখব না। কিন্তু যারা উপকৃত হয়েছে তারা আজীবন মনে রাখবে। তারা মনে না রাখলেও সৃষ্টিকর্তা ঠিকই তাকে এর প্রতিদান দেবেন। ভালো মানুষরা প্রতিদানের আশায় কিছু করেন না। তারা বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সুখানুভূতি লাভ করেন।মতিউর ভাই ভগ্ন হৃদয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলেন। জানলাম তার হাতে কোনো টাকা নেই। সুব্রত ভাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিলে হয়ত তার এই অবস্থায় দেশে যাওয়া হতো না।

তার কথা শুনে উপলব্ধি করলাম আমারও মাস শেষে হাতেও কোনো টাকা থাকে না। কোনো জরুরি কারণে বাড়ি যেতে হলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। প্রত্যেক প্রবাসীর উচিত বাড়িতে টাকা পাঠানোর পরও কিছু টাকা নিজের কাছে রাখা। কখন কোন জরুরি অবস্থায় প্রয়োজন হয় তাতো বলা যায় না।

প্রবাসে সবচেয়ে কষ্টকর হলো আপনজনদের মৃত্যু সংবাদ শুনে সারারাত বিছানায় ছটফট করা। শেষ বিদায়ে আপনজনের পাশে না থাকাটা যে কতটা কষ্টকর তা প্রবাসী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *