ফেলে দেয়া বই কুড়িয়ে লাইব্রেরি বানিয়ে ফেললেন ময়লাকর্মী !!

তিনি ছিলেন একটি ময়লা বহনকারী ট্রাকের ড্রাইভার। রাতের বেলা তার ডিউটি থাকত। ময়লাকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় তিনি খেয়াল করলেন, পঁচা ময়লা আ’ব’র্জ’নার সাথে বইও পড়ে আছে অনাদরে।শিক্ষিত হলেই মানুষ মানবিক হয়, শিক্ষার মর্ম বোঝে ব্যাপারটা এমন নয়। আবার তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও অনেকের পড়ালেখাপ্রীতি, বইপ্রীতি দেখার মতো। পল্টনের জ্যামে রিকশায় বসে আছি একদিন।

হুট করে আমাকে যিনি বহন করে নিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই রিকশাচালককে দেখলাম সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে একটা পত্রিকা কিনে আনলেন। জ্যামের মধ্যে সময়টাতে তিনি পত্রিকা পড়তে থাকলেন। এধরণের শিক্ষানুরাগী মানুষ আমাদের আশেপাশে খুঁজলে হয়ত অনেক পাওয়া যাবে।

এই মানুষগুলো তথাকথিত শিক্ষিতদের জন্য অনুসরণীয়, বিশেষ করে যারা পড়তে জেনেও বইবিমুখ থাকেন, পড়তে যেনেও কোনো কিছু যাচাই বাছাই না করে হুট হাট মন্তব্য করে বসেন। আজকে একজন কলম্বিয়ান মানুষের গল্প শুনাব। তিনি আপাতদৃষ্টিতে খুব উচ্চমার্গীয় ব্যক্তি নন। কিন্তু, তার ভাবনা অনেকের চাইতেই বেশি উচ্চতর।

ভদ্রলোকের নাম হোসে আলবার্তো গুটিরেজ। ১৯৯৭ সালে তিনি কলম্বিয়াতে একজন আবর্জনা সংগ্রহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন একটি ময়লা বহনকারী ট্রাকের ড্রাইভার। রাতের বেলা তার ডিউটি থাকত।

ময়লাকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় তিনি খেয়াল করলেন, পঁ’চা ময়লা আ’ব’র্জনার সাথে বইও পড়ে আছে অনাদরে। মানুষ হয়ত বইগুলো পড়ে ঘরে রাখার জায়গা না পেয়ে ময়লার সাথে দিয়ে দিয়েছে কিংবা তারা হয়ত কখনো এই বইগুলোর মর্যাদাই বোঝেনি।

লিও টলস্টয়ের ভুবনবিখ্যাত আন্না কারেনিনা বইটি যখন গুটিরেজ আবর্জনার মধ্যে খুঁজে পেলেন তিনি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। যে বইয়ের আবেদন কখনো ফুরায় না, সে বই কিনা লোকে ডাস্টবিনে ফেলে! এই বইয়ের স্থান তো এখানে নয়।

গুটিরেজ নিজে ময়লাকর্মী হতে পারেন। কিন্তু, তিনি ঠিকই টলস্টয়কে জানেন। তাই তিনি বইটি সংগ্রহ করে নিজের হেফাজতে রাখলেন। কিন্তু, এটাই শেষ নয়। প্রায় প্রতিসময়ই তিনি এরকম আ’ব’র্জনার মধ্যে অনেক ভাল ভাল বই খুঁজে পেতেন, বিশ্ব ক্ল্যাসিক বই থেকে হাল আমলের চলতি বাজারের বইও।

গুটিরেজ বইগুলো সংগ্রহ করতে থাকলেন। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু। এখনো তিনি এই কাজ করে যাচ্ছেন। অদ্ভুত হলেও সত্যি এবং আশ্চর্যের এই যে তার সংগ্রহশালায় বইয়ের সংখ্যা ছাড়িয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজারে! তিনি মনে করেন উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান যা রেখে যেতে পারি তা হলো শিক্ষা।

আর শিক্ষার হাতিয়ার বইয়ের এই বিপুল সংগ্রহশালা নিশ্চয়ই প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণা জোগাবে সবাইকেই, যেমনটা আমাদের দেশে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, পলান সরকারের মানুষের কথা ও কাজ স্মরণ রাখবে আমাদের দেশের পরের প্রজন্মও।

কলম্বিয়ার বোগাটায় একটি দরিদ্র অঞ্চলে থাকেন গুটিরেজ। এই এলাকার কিশোররা পড়ার সুযোগ পায় কদাচিৎ। অল্প বয়সে তাদের কাজের সন্ধ্যানে নেমে যেতে হয়। এমনই এক এলাকায় গুটিরেজ এখন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন।

তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য ময়লাবাহী ট্রাক ড্রাইভাররা এখন বই পেলে তাকে এসে দিয়ে যায়। তিনি শিক্ষা উপকরণ দিয়েছেন ২৩৫ টি স্কুল, কমিউনিটিকে। তার সংগৃহীত বইগুলো দিয়ে তিনি একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন।

৫৫ বছর বয়সী গুটিরেজ জীবনের সর্বশেষ বিশ বছর এই কাজ করে চলেছেন। সংগৃহীত বই তিনি দান করেন বিভিন্ন লাইব্রেরিতে। তার সংগ্রহের বইয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে ৪৫০টির অধিক লাইব্রেরি, রিডিং সেন্টার, স্কুলের পাঠকক্ষ।

তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন তিনি গোটা কলম্বিয়াকে বই দিয়ে পরিপূর্ণ করবেন। বই পড়া মানুষ যে পৃথিবীতে অনেক বেশি দরকার, সেটা তার খুব মনে হয়। যারা বই পড়ে তারা অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা হয়, ভালবাসায় চিন্তায় চেতনায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃত হয়।

সংকীর্ণ মানসিকতার লোকদের হাত থেকে, উগ্রপন্থীদের হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার বিপরীতে ভালবাসা হতে পারে কার্যকরী অ’স্ত্র। তাই গুটিরেজের বই নিয়ে এই যু’দ্ধ’টা চলমান আছে, থাকবে। তার একটি বক্তব্য দিয়ে লেখাটি শেষ টানছি। “Listen, if humans treated each other as they do in many of the books that I’ve read, this planet would be governed only by love.”

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *