‘ভগবানকে’ নিয়ে হাস্যরস করা যায়, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাবে না কেন ??

তসলিমা নাসরিন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আপোসহীন নারীবাদী লেখিকা। লেখালেখির জন্য অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন আবার বিতর্কিতও হয়েছেন। নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে তিনি শুধু ধর্মীয় মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হননি, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে যু’দ্ধ ঘোষণা করে। বরাবরই তিনি আলোচনার শীর্ষে থাকেন। ফের আলোচনার এসেছেন তিনি।

সম্প্রতি, বসন্ত উৎসবে কয়েকজন তরুণী হলুদ শাড়ি পরে পিঠে লিখেছেন অ’শ্লীল শব্দ। একইভাবে বুকে অ’শ্লীল শব্দ লিখেছেন কয়েকজন তরুণ। গত বৃহস্পতিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্ত উৎসবে অংশ নেন ওই তরুণ-তরুণীরা। তাদের সেই ছবি ও ভিডিও প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় সমালোচনা।

এমতাবস্তায়, শুক্রবার (৬ মার্চ) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিষয়টি নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তসলিমা নাসরিন।

তসলিমার স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে দেওয়া হলো…

‘ইউটিউবে গাঁজা খেয়ে বেসুরো গান গায় গালিবাজ রোদ্দুর রায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারও ভক্ত তৈরি হয়। একটি চাঁদ উঠেছিল গগনের ভিডিওতে তো প্রায় ৬০ লাখ লাইক পড়েছে। এর নাম বাস্তবতা। এর নাম আমাদের সময়, যে রকমই এই সময় হোক, এ আমাদের সময়।

এক সময় দেবব্রত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে রবীন্দ্র সঙ্গীত বিকৃত করার অভিযোগ উঠেছিল, সেই অভিযোগও আর নেই, সেই রক্ষণশীলতাও নেই, দেবব্রত বিশ্বাস বরং তার সব বিকৃতি নিয়েই আগের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আজকাল রোদ্দুর রায় জাতীয় লোকেরা রবীন্দ্র সঙ্গীত বিকৃত করছে। বিকৃত করাটাও কিন্তু এক ধরনের বাক স্বাধীনতা। তার যা খুশি সে তা বলছে, যেভাবে গান গাইতে ইচ্ছে করে, সেভাবে গাইছে। তার কিছু ভক্ত যদি শরীরে তার ফাজলামো ইতরামো এঁকে ঘোরাফেরা করে, তাতে কার কী ক্ষতি? এইসব বাঁড়া, শালা, বাঞ্চোত শব্দগুলো মূলত মানুষের তৈরি এবং ব্যবহৃত কোনো শব্দকেই রোদ্দুর রায় অশ্লীল বলে মনে করে না। সে মনে করে দারিদ্র্য অশ্লীল, প্রতারণা অশ্লীল, ঘৃণা অশ্লীল, হত্যাকাণ্ড অশ্লীল, যুদ্ধ অশ্লীল।

অশ্লীলতা ব্যাপারটা তো আসলে আপেক্ষিক, একজনের কাছে যা অশ্লীল, আরেকজনের কাছে তা অশ্লীল নয়। যে ভদ্রলোকেরা এই শব্দগুলোকে অশ্লীল বলছে, তাদের অনেকে মনে মনে এসব শব্দ বহুবার উচ্চারণ করে, অথবা এই শব্দগুলো তারা ঘরে বলে, বাইরে বলে না। বাইরে নকল হলেও ঝলমলে একটা সমাজ তারা দেখতে চায়। ১০০ বছর আগে যেমন ভাবে মানুষ চলতো, যেমন ভাবে বলতো, তেমন ভাবে আজও চলুক বলুক চায়।

কিন্তু সমাজ তো বদলে যাচ্ছে, আগের মতো কেন থাকবে সবকিছু! বদলের চাকা কিন্তু সবসময় ওপরের দিকে ওঠে না, নিচের দিকেও গড়ায়। বদলটা মনের মতো না হলে কান্নাকাটি করার তো দরকার নেই। বুঝতে হবে এই সমাজ এই মানসিকতা হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। একেই আমরা সকলে মিলে একটু একটু করে তৈরি করেছি। কোলকাতার শাসকেরা তো বাংলা অন্তপ্রাণ নিরীহ নিরপরাধ তসলিমাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে, ওই তাড়ানোর চেয়ে কি বাঁড়া শব্দটি বেশি অশ্লীল?

মানুষ এখনো অন্যায়ের ভেতর ততটা অশ্লীলতা দেখে না, যতটা দেখে দু’চারটা শব্দে এবং অঙ্গভঙ্গিতে। খুনোখুনিতে অশ্লীলতা দেখে না, যৌনসঙ্গমে দেখে। রবীন্দ্রনাথের যুগে ছোটরা বড়দের চোখে তাকিয়ে কথা বলতো না, এখন ছোটরা বাপকেও বলে দেয়, ‘ফাক, হোয়াট বুলশিট আর ইউ টকিং ম্যান!’ এসবকে যদি আমরা বিবর্তন বলি, আধুনিকতা বলি, স্মার্টনেস বলি, তবে মেয়েদের পিঠে হাস্যরসের জন্য লেখা ‘বাঁড়া চাঁদ উঠেছিল গগনে’ দেখলে আমরা আঁতকে উঠি কেন?

কে বলেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হাস্যরস করা যাবে না? ভগবানকে নিয়ে করা যায়, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাবে না কেন? যারা রবীন্দ্রনাথের দিকে কারোর ভেংচি কাটা বা কাদা ছোঁড়া দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে, রবীন্দ্রনাথকে বর্ম পরাতে চায়, তারা তার উচ্চতা সম্পর্কে সম্ভবত কিছুই জানে না।

বাঙালিরা আমেরিকার সমাজে বাস করার জন্য বড় ব্যাকুল। আমেরিকায় কি শুধু ডিগ্রি আর ডলারই ভেসে বেড়াচ্ছে, গালি ভাসছে না? নতুন প্রজন্ম ‘ফাক’ শব্দটি ছাড়া ক’টা বাক্য বলে শুনি! আমরা ছেলেমেয়েদের আমেরিকার স্বপ্ন দেখাব, আমেরিকার ফিল্ম দেখাব, হিপহপ শোনাব, কিন্তু বাংলা সংস্কৃতিকে ভালো না বাসলে, বাংলা গানকে বিকৃত করলে বা আমেরিকানদের মতো গালিগালাজ করলে কপাল থাপড়াবো, তা কেন?

চোখের জল মুছে ফেলে তার চেয়ে সন্তান সন্ততিদের এই শিক্ষা দিন ভাষা তার যাই হোক, কোনোদিন যেন প্রতারণা না করে, যেন কাউকে নির্যাতন না করে, যেন বর্বর না হয়, যেন লোভী না হয়, স্বার্থান্ধ না হয়। জগত হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু কারও কাছ থেকে চায়ও না।’

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *