মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে বয়টকের ডাক !!

রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর সেনাবাহিনীর গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে আগামীকাল আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানি শুরু হবে। শুনানির আগে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বিশ্বব্যাপী একটি প্রচারণা শুরু করেছে ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনসহ বিভিন্ন দেশে সক্রিয় থাকা রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু সংগঠন।

জাতিসংঘের ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজে’ (আইসিজে) অনুষ্ঠিতব্য এ শুনানিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্টেট কাউন্সিলর নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সান সু চি। শুনানি শুরুর আগেই ‘বয়কট মিয়ানমার ক্যাম্পেইন’ নামে মিয়ানমারকে বয়কট করার আহবান সম্বলিত একটি প্রচারণা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমর্থনকারী মানবাধিকার কর্মীরা মিয়ানমারকে বিশ্বব্যাপী বয়কটের এ প্রচারণা শুরু করেছেন।

সংগঠনটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণহত্যা মামলার শুনানিকে সামনে রেখে ৩০টি মানবাধিকার, শিক্ষাবিদ এবং পেশাদারদের সংগঠন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ফরসি ডট কো, রেস্টলেস বিংস, ডেস্টিনেশন জাস্টিস, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক অব কানাডা, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ অব ইন্ডিয়া ও এশিয়া সেন্টারের মতো সংগঠনগুলো।

বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে ‘গ্লোবাল বয়কট মুভমেন্ট’ শুরু হয়েছে একটি অনলাইন পিটিশন অভিযানের মাধ্যমে যেখানে নরওয়ের নোবেল কমিটিকে অং সাং সুচির নোবেল পুরস্কার বাতিলের আহবান জানানো হয়েছে।

কারণ তারা মনে করে মিয়ানমারের বেসামরিক এই নেতা এখন আর এই পুরস্কারের যোগ্য নন।

জার্মানি ভিত্তিক ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘গ্লোবাল বয়কট মুভমেন্ট’ এর অন্যতম উদ্যোক্তা নে সাং লুইন ওই বিবৃতিতে বলেন, জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান মিশন পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে যে জন্ম ও নাগরিকত্বের দিক আমার পূর্বপুরুষের দেশ আমাদের রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।

নে বলেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আমি নাগরিক বা ক্রেতা, অধিকার সংগঠনের সদস্য বা প্রতিনিধি, ধর্মীয় সম্প্রদায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বা পেশাজীবী বা সংসদীয় এসোসিয়েশনসহ সবাইকে নিজেদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা ব্যবহার করে মিয়ানমারের সাথে সব প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহবান জানাচ্ছি।

কর্মসূচি নিয়ে বয়কট রোহিঙ্গা ডট অর্গ তাদের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘২০১৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসে এসব সংগঠন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিয়ানমারকে বর্জনের আহ্বান সংবলিত প্রচারণা শুরু করেছে।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নৃশংসতা, গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পক্ষে প্রত্যক্ষ ও নথিভুক্ত প্রমাণ রয়েছে। সারা বিশ্ব এর নিন্দা জানালেও হতাশার কথা, এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ কথিত হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল।

গত দুই বছরে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের কথায় উঠে আসে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ, যাকে জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে জাতিসংঘ।

রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নালিশ গেছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জোট ওআইসি’র সমর্থনে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া নভেম্বরে জাতিসংঘের আদালত আইসিজে’তে মামলা করেছে।

গাম্বিয়া তাদের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ এবং তাদের আবাসন ধ্বংসের কথা বলেছে।

আন্তর্জাতিক আদালতে তিন দিনের শুনানিতে জাতিসংঘ নিযুক্ত ১৬ জন বিচারক প্যানেল উভয়পক্ষের আইনজীবীদের প্রশ্ন করবেন। আদালত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় পরিপূর্ণ শুনানির আগে অন্তর্বর্তী আদেশ দিতে পারেন। জাতিসংঘের অধীনে দু’ধরনের আন্তর্জাতিক আদালত আছে।

একটা হল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট’ (আইসিসি) এবং অপরটি হল ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজ’ (আইসিজে)। কোনো ব্যক্তি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধ করলে তার বিচার ও সাজা নির্ধারণ করে আইসিসি।

রোম চুক্তিতে যেসব দেশ সই করেছে, সাধারণত ওই দেশগুলোর কেউ গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে অপরাধী ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিসহ সাজা দিতে পারে আইসিসি।

বাংলাদেশ রোম চুক্তিতে সই করলেও মিয়ানমার এতে সই করেনি। আইসিসিতে এ কারণে বিচারে কিছুটা অসুবিধা থাকলেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সুপারিশ করলে আইসিসি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংগঠিত অপরাধের বিচার করতে পারে।

অপরদিকে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময়ই ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আইসিজে। দুই দেশ কোনো বিরোধে জড়ালে আইসিজে শুনানি গ্রহণ করে রায় দিতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমার ও গাম্বিয়া পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়বে।

আইসিজে রায়ে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বলতে পারে। কিংবা আইসিজে বলতে পারে যে, রোহিঙ্গারা ঐতিহ্যগতভাবে মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ার যোগ্য তাই তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার আদেশ দিতে পারে আন্তর্জাতিক এই আদালত।

তবে আইসিজে রায় কার্যকর করতে পারে না। মিয়ানমার, গাম্বিয়া, বাংলাদেশ আইসিজে’র সদস্য। ফলে রায় সদস্য দেশগুলো নিজেরা কার্যকর করতে পারে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রায় কার্যকরে পদক্ষেপ নিতে পারে।

সূত্র: বিবিসি

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *