মুসলমান নারীদের বর্ণনায় দিল্লি সহিং’সতা, ‘আমাদের দো’ষ, আমরা মুসলমান’ !!

ভারতের রাজধানী দিল্লির বেশ কিছু এলাকায় ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ ধর্মীয় দা’ঙ্গা আবারো প্রমাণ করলো যে, যেকোনো সহিং’সতায় সবচেয়ে বেশি শি’কা’র হয় নারী ও শিশুরা। দিল্লির উত্তর-পূর্ব অংশে সহিং’সতায় অন্তত ৪০জন নিহ’ত হয়েছে, যাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই রয়েছেন। হাজার হাজার নারী ও শিশু ঘরবাড়ি হা’রিয়েছে।

শহরের ইন্দিরা বিহার এলাকার একটি বড় কক্ষে সহিং’সতার কারণে বা’স্তুচ্যু’ত অসংখ্য নারী ও শিশু মাদুরের ওপর বসে রয়েছেন। অনেক তরুণীর কোলে শিশু রয়েছে, সেই সঙ্গে একটু বড় শিশুরাও আশেপাশে খেলা করছে। এই কক্ষটি একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর, যা এখন বা’স্তুচ্যু’ত মানুষজনের একটি আ’শ্রয়কে’ন্দ্রে পরি’ণত হয়েছে।

অন্যতম প্রধান দা’ঙ্গা উ’পদ্রু’ত এলাকা, শিব বিহারে নিজেদের বাড়িঘরে দা’ঙ্গাকারীরা হা’মলা করার পরে এই মুসলমান নারী ও শিশুরা পালিয়ে এসেছে। কর্মজীবী হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে অলিগলিতে ভরা শিব বিহারে বেশ বড় সংখ্যায় মুসলমানরা বসবাস করে। নোং’রা একটি নালার পাশ দিয়ে কয়েকশো মিটার দূরে চামান পার্ক আর ইন্দিরা বিহারে আবার মুসলমানরা সং’খ্যাগ’রিষ্ঠ।

মাত্র একটি সড়ক দ্বারা মুসলমান এবং হিন্দু সংখ্যাগ’রি’ষ্ঠ এলাকাগুলো আলাদা হয়ে রয়েছে। এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষরা বহুকাল ধরে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। কিন্তু সেই অবস্থার এখন পরিবর্তন হয়েছে। শিব বিহারের ঘরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসা একজন নারী নাসরিন আনসারী বলছেন, মঙ্গলবার দুপুরের পর সেখানে সহিং’সতা শুরু হয়, যখন শুধুমাত্র নারীরাই বাড়িতে ছিলেন। তাদের বাড়ির পুরুষরা তখন কয়েক মাইল দূরে, দিল্লির আরেক অংশে একটি ইজতেমায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন।

তিনি এবং অন্য নারীরা তাদের বাসার জানালা এবং বারান্দা দিয়ে তাদের দেখছিলেন। একটু পরেই তারা বুঝতে পারে, এই মানুষগুলো তাদের র’ক্ষা করার জন্য আসেনি। নাসরিন বলছেন, ”আমার ৫০-৬০জন মানুষকে দেখতে পাই। তারা কারা জানি না, আগে কখনো দেখিনি। তারা আমাদের বলে, আমরা তোমাদের র’ক্ষা করতে এসেছি, তোমরা ঘরের ভেতরে থাকো।”

একটি ভিডিও দেখান নাসরিন, যা তিনি বাসার জানালা থেকে ভিডিও করেছিলেন। সেখানে বেশ কয়েকজন পুরুষকে দেখা যায়, যারা সবাই হেলমেট পরে রয়েছেন এবং হাতে লম্বা কাঠের লাঠি রয়েছে। নাসরিন বলছিলেন, এই পুরুষরা জয় শ্রী রাম এবং হনুমান চালিসার মতো হিন্দু ধর্মীয় শ্লো’গা’ন দিয়ে চিৎকার করছিলেন। তার মা নুর জাহান আনসারী বলছেন, একজন মুসলমান প্রতিবেশী তাকে ডেকে বলেন যে, তার বাড়িতে আ’গুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ”আমাদের জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম, আরেকজন মুসলমান প্রতিবেশী এবং তার ওষুধের দোকান আগুনে জ্বলছে।” হা’মলাকারীরা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ভা’ঙচুর করে এবং ধুলায় পুরো এলাকা আ’চ্ছা’দিত হয়ে যায়।

তিনি বলছেন, ”কিছুক্ষণ পরে আমাদের চারদিকেই যেন আ’গুন জ্ব’লতে শুরু করে। তারা মুসলমানদের দোকান এবং বাড়িঘর লক্ষ্য করে মলো’টভ ক’কটেল এবং রান্নার গ্যা’স সি’লি’ন্ডার ছু’ড়ে মা’রছিল। কিন্তু কোন হিন্দু বাড়িতে হা’মলা করেনি। আমরা কখনো ভাবিনি, এরকম কোন কিছু কখনো ঘটতে পারে। আমাদের একমাত্র দোষ, আমরা মুসলমান।”

নাসরিন বলছেন, ”নারীরা তখন পুলিশের কাছে অনেকবার টেলিফোন করে। প্রত্যেকবার তারা আমাদের আশ্বস্ত করছিল যে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে তারা এখানে পৌঁছে যাবে।” একপর্যায়ে নাসরিন কয়েকজন আত্মীয়কে টেলিফোন করে বলেন, আজ রাতে তাদের আর র’ক্ষা হবে না। হা’মলা শুরুর প্রায় ১২ ঘণ্টা পর অবশেষে রাত তিনটার দিকে তাদের উ’দ্ধা’র করা হয়, যখন চামান পার্ক আর ইন্দিরা বিহারের মুসলমান ব্যক্তিরা পুলিশের সঙ্গে সেখানে পৌঁছান।

”আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে ছুটছিলাম। এমনকি পায়ে জুতা পড়ার সময়টাও পাইনি,” তিনি বলছেন। ওই আশ্রয় কেন্দ্রের আরো কয়েকজন নারী সেই রাতের ব’র্ণনা দিতে গিয়ে একই রকম কাহিনী বললেন। উনিশ বছর বয়সী শায়রা মালিক বলছেন, তিনি এবং তার পরিবার একজন প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ”আমরা যেন সেখানে ফাঁদে আ’টকে পড়েছিলাম। বাইরে থেকে বৃষ্টির মতো সেখানে পা’থর আর মলো’টভ ককটেল ছুড়ে মা’রা হচ্ছিল।”

অনেক নারী বিবিসির সংবাদদাতাকে বলেছেন, সেদিন রাতে শারিরীক হা’মলার কতো কাছাকাছি থেকে তারা বেঁচে গিয়েছেন। হা’মলাকারীরা তাদের স্কার্ফ খুলে ফেলেছিল এবং কাপড়চোপড় ছিঁ’ড়ে ফেলেছিল। কীভাবে ঘরে ঢুকে কয়েকজন ব্যক্তি তার কাপড়চোপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে, সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে ফুঁ’পিয়ে কাঁদতে শুরু করেন একবছর বয়সী একটি শিশুর মা- একজন নারী।

ত্রিশ বছর বয়সী আরেকজন নারী বলছেন, তার একজন হিন্দু প্রতিবেশীর সহায়তার কারণেই তিনি বেঁচে আছেন। ওই নারী বলছেন, ”আমার প্রতিবেশী হা’মলাকারী ব্যক্তিদের বলেন, আমি তাদের পরিবারের সদস্য। এখানে কোন মুসলমান নারী নেই। দা’ঙ্গাকারীরা পেছন দিকে চলে গেলে তিনি আমাকে পা’লিয়ে যেতে সাহায্য করেন।”

এই অর্থহীন সহিসং’তার শুরু হয় রবিবার বিকাল থেকে যখন নতুন বি’ত’র্কিত নাগরিকত্ব আইনের সমর্থক ও বি’রো’ধিতা কারীরা শিব বিহারের কয়েক কিলোমিটার দূরে সং’ঘ’র্ষে জড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আশেপাশের এলাকাগুলোয় সহিং’সতা ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে রয়েছে শিব বিহার এবং চামান পার্ক।

সংবাদদাতা যখন ওই এলাকার ভেতর দিয়ে হাটছিলেন, সেখানকার পথেঘাটে তখনো সহিং’সতার ছাপ দৃশ্যমান হয়ে ছিল। অনেক দা’ঙ্গা পুলিশ স’ত’র্ক ন’জ’র রাখছেন, যাতে আর নতুন করে কোন সহিং’সতার শুরু না হয়। সড়ক জুড়ে ইট আর পাথরের টু’করো ছড়িয়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও আ’গুনে পোড়া গাড়ি, দোকান এবং বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। শিব বিহারে একটি মসজিদেও আ’গুন ধ’রিয়ে দেয়া হয়েছিল।

ইন্দিরা বিহারের আশ্রয় কেন্দ্রে নারীরা বলছেন, তাদের কোন ধারণাই নেই যে, কখন তারা আবার নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে পারবেন। শাবানা রেহমান বলছেন, তার তিনটি সন্তান ক্রমাগতভাবে তাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন যে, কবে তারা নিজেদের বাড়িতে যাবে। ”অ’গ্নিসংযো’গকারীরা আমাদের বাড়িতে আ’গুন দিয়ে পু’ড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এখন কোথায় যাবো? আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী? আমাদের এখন কে দেখবে? আমাদের সব কাগজপত্র পুড়ে গেছে।”

যখন তিনি এই কথা বলছিলেন, তখন তার চোখ থেকে অ’শ্রু গড়িয়ে নামছিল। বহু বছর ধরে বসবাস করে আসা তার শিব বিহারের বাড়িটি স্বল্প হাটা পথের দূরত্বে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন সেই দূরত্ব যো’জন যো’জন দূরে। সূত্র : বিবিসি

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *