যে হুমকি দিয়ে সুমনকে বিয়ে করেন পাপিয়া !!
অভিজাত এলাকায় জমজমাট নারী ব্যবসাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়জড়িত নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিস্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ ও তার স্বামী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমন ছিলেন নরসিংদীর আলোচিত চরিত্র। বন্ধু থেকে একপর্যায়ে সুমনের প্রেমিকা হন পাপিয়া। বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ার পরও রাজি না হওয়ায় সুমনকে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। পরে বাধ্য হয়ে পাপিয়াকে বিয়ে করেন সুমন। সুমনের হাত ধরে পাপিয়ার উত্থান হলেও একপর্যায়ে প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ক্ষমতায় স্বামীকেও ছাড়িয়ে যান পাপিয়া। নিজেই গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী। গ্রেপ্তারের পর পাপিয়া ও তার স্বামীর ব্যাপারে বেরিয়ে আসছে অনেক চমকপ্রদ তথ্য।
নরসিংদী সরকারি কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র জানান, সুমন ও পাপিয়া ছিলেন নরসিংদীর আলোচিত চরিত্র। একদিন পাপিয়া কলেজের ভেতরে সুমনকে বিয়ের জন্য চাপ দেন। এতে রাজি না হলে পাপিয়া তাকে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এ নিয়ে পাপিয়া ও সুমনের গ্রুপের মধ্যে কলেজে মারামারি হয়। প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও পাপিয়াকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে চাননি সুমন। পরে বাধ্য হয়ে পাপিয়াকে বিয়ে করেন সুমন।
তিনি জানান, সুমনের বাবা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি নরসিংদীর নজরুল একাডেমির প্রধান। তার দুই ছেলের মধ্যে সুমন ছোট। সুমন নামে একাধিক যুবক থাকায় বাবার নামের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে অনেকে তাকে মতি সুমন নামে ডেকে থাকেন। সুমনের আরেক ভাই নামকরা গিটার বাদক। ছোটবেলা থেকে সুমনের বেপরোয়া জীবন-যাপনের কারণে তার পরিবারের সদস্যরা বিব্রত হতেন। সুমনের বিরুদ্ধে মানিক কমিশনার হত্যাসহ চারটি মামলা আছে।
নরসিংদীর একাধিক বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, একসময় পাপিয়া নরসিংদী সরকারি কলেজে লেখাপড়া করতেন। ওই সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় মতি সুমনের। পরিচয় হওয়ার পর তারা ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন। বন্ধু থেকে একপর্যায়ে মতি সুমনের প্রেমিকা হন পাপিয়া। মতি সুমনের হাত ধরে রঙিন দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে পাপিয়ার। কলেজের সাধারণ ছাত্রী হয়েও মতি সুমনের মাধ্যমে প্রথমে নরসিংদীর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় অনেক রাজনৈতিক নেতা পাপিয়াকে তাদের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় পাপিয়ার বেপরোয়া জীবন। নরসিংদীর প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হওয়ায় মতি সুমন ও পাপিয়ার ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের দিকে নরসিংদী সরকারি কলেজে প্রথম ছাত্রী হোস্টেল উদ্বোধন হয়। ওই সময় হোস্টেলের একটি কক্ষ নিজেদের আস্তানা বানিয়েছিলেন পাপিয়া। সেখানে অনেক বহিরাগত ছাত্রীর যাতায়াত ছিল। কোনো কোনো ছাত্রীকে প্রলোভন ও চাপ দিয়ে ওই সময় খারাপ পথে নিয়েছিলেন তিনি। তখনও স্থানীয় অনেকে পাপিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অবগত ছিলেন।
জানা গেছে, লোকমান হত্যার পর সুমন ও পাপিয়া চেনা দুনিয়ার কিছুটা রঙ বদলাতে থাকেন। একপর্যায়ে লোকমানের ভাই বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তারা। তবে অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে কামরুজ্জামান তাদের এড়িয়ে চলতেন। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে মতি সুমনের নরসিংদীর বাসায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। সেই হামলায় পাপিয়া গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলার পরপরই মূলত মতি সুমন ও পাপিয়া নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় এসে আশ্রয় নেন। তবে তারা মাঝে মাঝে নরসিংদীতে যাতায়াত করতেন। পরে তারা নরসিংদী সদরের বর্তমান এমপি নজরুল ইসলাম হিরুর আস্থা-ভাজন হয়ে ওঠার চেষ্টা-তদবির চালান।
একাধিক সূত্র জানায়, নরসিংদীর তরুণ-যুব প্রজন্মকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা ধরনের কৌশল ছিল মতি সুমন ও পাপিয়া দম্পতির। প্রায়ই শহরের নানা জায়গায় ডিজে পার্টির আয়োজন করতেন তারা। যারা এই দম্পতির ঘনিষ্ঠ ছিল তারা ‘কেএমসি’ বাহিনী নামে পরিচিত। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির নামে এই বাহিনী গড়ে তোলেন সুমন ও পাপিয়া। মাদক, টেন্ডার, অস্ত্রবাজি, জমি দখল, চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা আদায় করা ছিল এই বাহিনীর কাজ। পাপিয়া নিজের হাতে ট্যাটু আঁকতেন। আবার কেএমসি বাহিনীর সদস্যদের হাতে একই ধরনের ট্যাটু আঁকতে বাধ্য করতেন। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মাদকের পার্টির আয়োজন করতেন তারা। তাদের ছিল হোন্ডা বাহিনী। কেএমসির সদস্যদের জন্য বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল কিনে দেন পাপিয়া। আবার দীর্ঘদিন নরসিংদীতে মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই দম্পতি। মতি সুমন তার আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিঠুন সাহার মাধ্যমে মাদক বাণিজ্য চালাতেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে সম্প্রতি মিঠুন দেশ ছাড়েন।
পাপিয়ার বাবা সাইফুল বারী আগে গণপূর্তের সাবেক গাড়িচালক ছিলেন। স্বামীর হাত ধরে পাপের রাজ্যে আসা পাপিয়া একসময় নরসিংদীর স্থানীয় রাজনীতির বাইরেও কেন্দ্রীয় প্রভাব বাড়াতে থাকেন। স্থানীয় নেতাদের বিরোধিতার মুখেও মহিলা যুব লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের আনুকূল্য পেয়ে হঠাৎ নরসিংদী জেলা মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। ঢাকায় পাঁচতারকা হোটেলে গড়ে তোলেন বিরাট অপরাধ সাম্রাজ্য। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইল করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন। অনৈতিক কার্যকলাপের ভিডিও ধারণ করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ছিল অন্যতম প্রধান পেশা। গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মসূচিতে হাজির হতেন সদর্পে। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের সঙ্গে ছবিও তুলতেন হরহামেশা। এলাকায় তিনি এও প্রচার চালাতেন, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হচ্ছেন তিনি।
নরসিংদী জেলা শহরের বাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় একটি পাকা ও আরেকটি সেমিপাকা টিনশেড বাড়ি আছে পাপিয়ার। সেমিপাকা টিনশেড বাড়িটি তিনি এবং তার অনুসারীরা বিরোধীদের শায়েস্তা করার জন্য টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন। একই এলাকার বেলদী মোড়ে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ এবং আরেকটি ছয় শতাংশের মূল্যবান দুটি প্লট রয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণদীতে স্বামীর দোতলা একটি বাড়ি আছে। রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে ‘রওশন ডমিনো রিলিভো’ বিলাসবহুল ভবনে তার ও তার স্বামীর নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া তার কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়া ও একটি ভিজেল কার আছে।
গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে মতি সুমন জানান, একপর্যায়ে পাপিয়া তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান। স্বামী হলেও তার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য তিনি কমই দিতেন। পাপিয়ার ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু চলত। পাপিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি তিনি নিয়মিত ফেসবুকে প্রচার করতেন।
জানতে চাইলে নরসিংদী সদর আসনের এমপি নজরুল ইসলাম হিরু বলেন, পাপিয়া তার রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না। ওদের মতো নোংরা ছেলেমেয়েকে তার আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আগেই মেয়র লোকমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন পাপিয়ার স্বামী মতি সুমন। তার দেহরক্ষী ছিলেন সুমন। স্থানীয় মতামত উপেক্ষা করে পাপিয়াকে নরসিংদী জেলা মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল।
মেয়র লোকমানের ভাই নরসিংদী জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ বলেন, লোকমানের সঙ্গে যখন সুমন চলতেন, তখন তার এত অপকর্মের খবর কারও জানা ছিল না। পাপিয়াকেও আমরা চিনতাম না। হঠাৎ ২০১৪ সালে পাপিয়া যুব মহিলা লীগের নেত্রী হয়ে যান।
তার আগে তিনি আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আর ২০১১ সালে সুমন পাপিয়াকে বিয়ে করার পর তাকে চিনতে পারি। উগ্র চলাফেরার কারণে সুমন ও পাপিয়াকে নরসিংদীর বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান কখনও তার কাছে ঘেঁষতে দেননি। কারা সুমন আর পাপিয়াকে প্রশ্রয় দেয় তা নরসিংদীর সবার জানা।মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, পাপিয়া-সুমন দম্পতি ও তাদের সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সত্য তথ্য বের করে আনা হবে।
সূত্রঃ বিডি২৪লাইভ