রোহিঙ্গা সুরক্ষায় ৬ অন্তর্বর্তী নির্দেশনা চায় গাম্বিয়া !!

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের (আইসিজে) কাছে ছয়টি অন্তর্বর্তী নির্দেশনা চেয়েছে গাম্বিয়া। রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার তৃতীয় দিনের শুনানিতে বৃহস্পতিবার বাদীপক্ষ এ আবেদন জানায়।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের ওই আদালতে আগের দিন মিয়ানমারের দেয়া বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে অভিহিত করেন গাম্বিয়ার আইনজীবীরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার না করার মধ্য দিয়েই মিয়ানমার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা গণহত্যায় জড়িত। কাজেই তাদের শাস্তির মুখোমুখি হওয়া উচিত। এ ছাড়া জড়িতদের বিচারে মিয়ানমারের আশ্বাসে আস্থা রাখা যায় না।

‘জেনেভা কনভেনশনের’ অধীন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার করা মামলায় বৃহস্পতিবার শেষ দিনের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় সময় সকালে গাম্বিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে দেশটির আইনমন্ত্রী আবু বকর তামবাদু রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আইসিজের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আদালতে ছয়টি অন্তর্বর্তী নির্দেশনার আবেদন করেন।

এর মধ্যে রাখাইনে সেনা অভিযান এবং রোহিঙ্গা বন্দিশিবির বন্ধ, রাজ্যটিতে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি, জাতিসংঘের সুপারিশ বাস্তবায়ন অন্যতম। মিয়ানমারের দাবি খণ্ডন ও যুক্তি উপস্থাপনে তামবাদু বলেন, ওই দেশে (মিয়ানমার) রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে। গাম্বিয়া প্রতিবেশী না হতে পারে, কিন্তু গণহত্যা সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গণহত্যা বন্ধ এবং তা প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে গাম্বিয়া ওআইসির (ইসলামিক অর্গানাইজেশন অব কো-অপারেশন) সহায়তা চেয়েছে। কিন্তু সার্বভৌম দেশ হিসেবে গাম্বিয়া একা এ আবেদন করেছে।

শুনানির প্রথম দিন মঙ্গলবার গণহত্যা বন্ধে আদালতের কাছে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেছিল গাম্বিয়া। পরদিন মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে দেশটির বেসামরিক শীর্ষ নেত্রী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাস দমনে সশস্ত্র বাহিনী মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে থাকলে তা দেশটির নিজস্ব ব্যবস্থায় বিচার করার কথা বলেছেন। কোনো প্রাণহানি ও নৃশংসতায় গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়নি দাবি করে মিয়ানমারের আইনজীবীরা গাম্বিয়ার আবেদন খারিজ করা উচিত বলে বক্তব্য দেন। গাম্বিয়ার পক্ষে বৃহস্পতিবার আদালতে দেশটির আইনমন্ত্রী ছাড়াও তিনজন আইন বিশেষজ্ঞ মিয়ানমারের দাবিগুলো খণ্ডন করে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তাদের মূল বক্তব্য ছিল- মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রতি অন্যায়-অবিচারের কথা অস্বীকার করেনি। ওই সব আচরণ বা কার্যক্রমে গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল না বলে মিয়ানমারের যে দাবি, তা বিভ্রান্তিকর এবং আন্তর্জাতিক আইনের অপব্যাখ্যা।

আইসিজের প্রেসিডেন্ট আবদুল কোয়াই আহমেদ ইউসুফের নেতৃত্বে বিচারকদের সামনে শুরু হওয়া তৃতীয় দিনের শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষে প্রথমে বক্তব্য দেন আইনজীবী পল রাইখার। তিনি মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আগ পর্যন্ত বিচারকদের কাছে বারবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ দাবি করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বর নির্যাতনে গণহত্যার উদ্দেশ্যের বিষয়টি অস্বীকার করছে। মিয়ানমারের আইনজীবী অধ্যাপক সাবাস গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন।

সেই সাতটি নির্দেশকের কথা গাম্বিয়ার আবেদনে রয়েছে এবং মিয়ানমার সেগুলো অস্বীকার করেনি। আদালত নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সু চি আদালতে রোহিঙ্গা বিশেষণটি ব্যবহার করেননি। শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদী আরসা গোষ্ঠীর কথা বলার সময় ছাড়া তিনি তাদের মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, দেশটি তাদের প্রতি কতটা বিদ্বেষপরায়ণ ও নির্মূলে সচেষ্ট। বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের বক্তব্যকে প্রতারণা হিসেবে উল্লেখ করে রাইখার বলেন, মিয়ানমার নিজেই স্বীকার করেছে যে, খুব সামান্য সংখ্যায় রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরেছে।

তাদের আইনজীবী ওকোয়া প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ এবং চীন, জাপান ও ভারতের সহায়তার বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সবাই প্রত্যাবাসন চান। কিন্তু প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমারের। তারা সেটি পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শুনানির সময় মিয়ানমার এমনকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বর্বর নির্যাতনের অভিযোগ বা ২০১৭ সালের সাঁড়াশি অভিযানের পর রোহিঙ্গাদের ব্যাপকভাবে দেশান্তরের অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টাও করেনি।

সেনাসদস্যদের সংঘটিত গণধর্ষণের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, এমন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কি সন্ত্রাস মোকাবেলা করা যায়? রোহিঙ্গাদের নির্যাতনকারীদের বিচার করা নিয়ে সু চির আশ্বাস বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন রাইখার।

তিনি বলেন, কীভাবে এটা আশা করা যায় যে, ‘তাতমাদো’ (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী) তাদের নিজেদের বিচার করবে? যখন মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনীর শীর্ষ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘের স্বাধীন অনুসন্ধানেও বিষয়টি উঠে এসেছে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

আইনজীবী পিয়েঁর দ্য আর্জেন বলেন, গাম্বিয়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মামলা করেছে। গাম্বিয়া ওআইসির সহায়তা নেয়ায় বলা যাবে না যে, ওআইসি এ মামলার আবেদনকারী। মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকারের বলেছেন, কোনো অপরাধ যদি ঘটেও থাকে তাহলেও গাম্বিয়ার সে বিষয়ে মামলা করার অধিকার নেই। স্টকারের বক্তব্য সঠিক নয়; গাম্বিয়া জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে সনদ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদনের অধিকার রাখে।

অধ্যাপক স্যান্ডস বলেন, গণহত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিয়ানমারের আইনজীবী অধ্যাপক সাবাস একটি নতুন আইনগত মান নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন, যেটি পরীক্ষিত নয়। (সাবাস বলেছিলেন, মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু গণহত্যা নয়। গণহত্যার উদ্দেশ্য সেখানে অনুপস্থিত।) অধ্যাপক সাবাস শিক্ষাবিদ হিসেবে ২০১৩ সালে গণহত্যা কাকে বলে তার ব্যাখ্যায় আলজাজিরাকে কী বলেছিলেন তা উল্লেখ করে স্যান্ডস বলেন, সেই সাক্ষাৎকারে গণহত্যা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলেছিলেন সেগুলো যদি আদালত তার নির্দেশে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাতে আমরা আপত্তি করব না।

অন্তর্র্বর্তী আদেশ পরিস্থিতির জন্য সহায়ক হবে না মিয়ানমারের এমন দাবির জবাব হচ্ছে, আমরা সে কারণেই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছি। বসনিয়ায় আদেশ দেয়ার পরও সেব্রেনিৎসায় গণহত্যা হয়েছিল- সেই দৃষ্টান্ত দিয়েই আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন এবং এটি বাস্তবায়নে সময় বেঁধে দেয়া জরুরি।

এদিন আদালতে ৯০ মিনিট ধরে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরেন গাম্বিয়ার আইনজীবীরা। স্থানীয় সময় বিকালে মিয়ানমারের আইনজীবীরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এরপর তিন রোহিঙ্গার সাক্ষ্য নেয়া হয়।

১৭ জন বিচারপতির উপস্থিতিতে আইসিজেতে তিন দিন ধরে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আইসিজের রেজিস্ট্রারের দফতর জানিয়েছে, ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যে বিচারকরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আইসিজেতে এটি তৃতীয় গণহত্যা মামলার শুনানি।

ওআইসিভুক্ত দেশ গাম্বিয়া ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তির বিধানে ১৯৪৮ সালে স্বাক্ষরিত ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে এ মামলা করে। মামলার চূড়ান্ত রায় হতে কয়েক বছর লাগতে পারে।

অক্সফামের প্রতিক্রিয়া : আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম। সংস্থাটির হিউম্যানিটারিয়ান ক্যাম্পেইন প্রধান ফিয়োনা স্মিথ বলেন, রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সব নৃ-জাতিগোষ্ঠী/সম্প্রদায় তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর চালানো সহিংসতার বর্ণনা দিয়েছে।

মিয়ানমারে সবচেয়ে শোচনীয় এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানাচ্ছি।

রাখাইন রাজ্যে অনতিবিলম্বে চলমান সহিংসতা বন্ধে সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে জোর দাবি করছি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *