সিঙ্গাপুরে এতো বাংলাদেশি শ্রমিক করোনা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কেন ??
সিঙ্গাপুরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের একটি বড় অংশ সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি হওয়ার কারণে এখন এই প্রশ্ন উঠছে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট এই দেশটিতে এত বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরকে একটি সফল উদাহরণ হিসেবেই এত দিন মনে করা হচ্ছিল।
করোনা ভাইরাস শব্দটি যখন অনেকের কাছেই পরিচিত হয়ে ওঠেনি, তখনই সিঙ্গাপুর দেশটিতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে এবং আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে। এর মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করেছিল দেশটি। কিন্তু অতি সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বেশ দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করছে। বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ ২৮৭ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ১৪২ জন।
সিঙ্গাপুরে আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিক। এদের মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করে তথ্যে দেখা যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বাংলাদেশিদের সংখ্যাটি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১,৯১০ জন, যাদের মধ্যে ৩৬৩ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। আক্রান্তদের মধ্যে একজন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বাংলাদেশি শ্রমিকরা কেন বেশি আক্রান্ত?
দীর্ঘদিন যাবত সিঙ্গাপুরে বসবাস করেন বাংলাদেশি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল মান্নান। সেখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন মি. মান্নান। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশিদের মাঝে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হার বেশি হওয়ার একটি কারণ অল্প জায়গায় অনেক বেশি শ্রমিকের বসবাস। এছাড়া সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা সবসময় দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করেন, ফলে তাদের মধ্যে বেশ দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে মি. মান্নান উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, বাঙালি শ্রমিকদের সমস্যা হচ্ছে, প্রতি রবিবার তারা এক জায়গায় জড়ো হয়। মোস্তফা মার্টের সামনে একটা মাঠ আছে। সেখানে তারা দলবদ্ধভাবে বসে আড্ডা দেয়, খাবার খায়। ইন্ডিয়ান বা চায়নিজরা এটা করে না। রবিবার যদি আপনি মোস্তফা মার্ট এলাকায় যান, তাহলে নড়তেই পারবেন না। লোক গিজ-গিজ করে, জানান মি. মান্নান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা সবাই এক জায়গায় থাকতে চায়। এছাড়া শুরু থেকেই করোনা ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে তেমন কোন সচেতনতা ছিল না বলে জানান এই সিঙ্গাপুর প্রবাসী। তিনি বলেন, তাদের ধারণা ছিল যে করোনা ভাইরাস তাদের ধরবে না। তারা মনে করতেন, এটা শুধু চায়নিজদের হয় আর বয়স্কদের হয়। সিঙ্গাপুরে বসবাসরত বাংলাদেশি সাংবাদিক ওমর ফারুকী শিপন জানান, বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম দিকে দুই-একজনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকলেও তারা সেটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। তিনি বলেন, অনেকে বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করেছে, ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ বেশ বেড়ে গেছে।
করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত প্রায় ২০,০০০ অভিবাসী শ্রমিককে কোয়ারেন্টিন করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এজন্য শ্রমিকরা থাকেন এমন দু’টি ডরমিটরি অর্থাৎ আবাসস্থলকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। পাঙ্গল এলাকায় এস-১১ ডরমিটরিতে ১৩,০০০ শ্রমিক থাকেন। এছাড়া ওয়েস্টাইল টোহ গুয়ান ডরমিটরিতে শ্রমিক থাকেন ৬,৮০০ জন। এসব ডরমিটরিতে মূলত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নির্মাণ শ্রমিকেরা বসবাস করেন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এই দু’টি আবাসিক ভবনে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের হার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে কোয়ারেন্টিনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ রকম একটি ডরমিটরিতে বাস করেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রিপন চৌধুরী। তিনি জানান, তিনি যে কক্ষে বসবাস করেন, সেখানে মোট ১৬ জন থাকেন।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে আট জনকে এরই মধ্যে সরিয়ে অন্য জায়গায় নেয়া হয়েছে। আমরা যারা যারা বাংলাদেশি শ্রমিক, আমরা সাধারণত হাইজিন মেইনটেইন করি না। আমরা খুব কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করি, সরল স্বীকারোক্তি দেন রিপন চৌধুরী। আর এ বিষয়টি সংক্রমণের অন্যতম কারণ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশি সাংবাদিক ওমর ফারুকী শিপন বলেন, এসব ডরমিটরি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। কোন কোন রুমে ৩২ জন পর্যন্ত বসবাস করে। এটা নির্ভর করে রুমের সাইজের উপর। এসব ডরমিটরিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোন সুযোগই নেই।
করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সিঙ্গাপুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং জরুরি সেবা ছাড়া অন্য কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা বলে মনে করা হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণে দেশটিতে এখনো পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছয় জন। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় এ সংখ্যা একবারেই নগণ্য।
বাংলাদেশে দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিক ওমর ফারুকী শিপন বলেন, অভিবাসী শ্রমিক হলেও বাংলাদেশিদের চিকিৎসার ব্যাপারে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ কোন ত্রুটি রাখছে না। তাদেরকে ভালো চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অভিবাসী শ্রমিক বলে তাদের অবজ্ঞা করা হচ্ছে না, বলেছিলেন তিনি।বিবিসি বাংলা।
সিঙ্গাপুরে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিকেরা আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনগুলোতে তাদের মধ্যে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টার লরেন্স উং বৃহস্পতিবার বলেছেন, করোনা ভাইরাস কতো দ্রুত ছড়ায় তা যদি তারা আরও আগে জানতে পারতেন, তাহলে হয়তো ভিন্নভাবে কাজ করা যেতো। আশংকা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহে কিংবা তারও খানিকটা পরে সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসের বিস্তার আরও ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে।