মুনাফিক মুসলমান সম্পর্কে সূরা বাকারা কী বলেছে ??
‘বাকারাহ’ মানে গাভী। এ সূরার ৬৭ থেকে ৭৩ নম্বর আয়াত পর্যন্ত হজরত মূসা (আ.)-এর সময়কার বনি ইসরাইলের গাভী কোরবানির ঘটনা বয়ান থাকায় এমন নামকরণ।
এ সূরার বেশি আয়াত মহানবী (সা.)-এর মাদানি জীবনের প্রথম দিকে নাজিল হয়। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যে যে আয়াতগুলো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের শেষ পর্যায়ে নাজিল হয়েছে সেগুলোও এখানে সংযোজিত হয়েছে। যে আয়াত দিয়ে সূরাটি শেষ করা হয়েছে তা হিজরতের আগে মক্কায় নাজিল হয়েছে।
সূরাটি বুঝতে হলে প্রথমেই এর ঐতিহাসিক পটভূমি বুঝে নিতে হবে। (১) হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল কেবল মক্কায়। এ সময় পর্যন্ত সম্বোধন করা হচ্ছিল কেবল আরবের মুশরিকদের। তাদের কাছে ইসলামের বাণী ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। এখন হিজরতের পর ইহুদিরা সামনে হাজির। তাদের জনবসতিগুলো ছিল মদিনার কোলঘেঁষে। তারা তাওহিদ, রিসালাত, ওহি, আখিরাত ও ফেরেশতার স্বীকৃতি দিত। এমনকি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবী মূসা আলাইহিস সালামের ওপর যে শরিয়ত নাজিল হয়েছিল তারও স্বীকৃতি দিত! নীতিগতভাবে তারাও সেই দ্বীনের অনুসারী ছিল, যার শিক্ষা হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিচ্ছিলেন।
কালের পতন ও অবনতির ফলে তারা সহি দ্বীন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। তাদের আকিদায় অযাচিত বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তাওরাতে যার কোনো ভিত্তি ছিল না। তাদের কর্মজীবনে এমন রীতি-পদ্ধতির প্রচলন ঘটে গিয়েছিল- দ্বীনের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাওরাতে তারা মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে ফেলেছিল।
এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় পৌঁছার পর ইহুদিদের আসল দ্বীনের দিকে আহ্বান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন। সূরা বাকারার ১৫ ও ১৬ রুকু এ দাওয়াত সংবলিত। এ দুই রুকুতে যেভাবে ইহুদিদের ইতিহাস এবং তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে এবং যেভাবে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মোকাবিলায় যথার্থ দ্বীনের মূলনীতিগুলো পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার মোকাবিলায় যথার্থ ধার্মিকতা কাকে বলে, সত্য ধর্মের মূলনীতিগুলো কী এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন কোন জিনিস যথার্থ গুরুত্বের অধিকারী তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তৎকালীন প্রায় ১৯শ’ বছর আগে হজরত মূসার (আ.) যুগ অতীত হয়েছিল। ইসরাইলি ইতিহাসের হিসাবমতে হজরত মূসা (আ.) খ্রি. পূ. ১২৭২ অব্দে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন।
মদিনায় পৌঁছার পর ইসলামি দাওয়াত একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। মক্কায় তো কেবল দ্বীনের মূলনীতিগুলোর প্রচার এবং দাওয়াত গ্রহণকারীদের নৈতিক প্রশিক্ষণের মধ্যেই ইসলামি দাওয়াতের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু হিজরতের পর যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে চতুর্দিক থেকে মদিনায় এসে জমায়েত হতে থাকল এবং আনসারদের মাধ্যমে একটি ছোট্ট ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত গড়ে উঠল, তখন আল্লাহ সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আইন সম্পর্কিত মৌলিক বিধান নাজিল করতে থাকলেন।
ইসলামি মূলনীতির ভিত্তিতে এ নতুন জীবন ব্যবস্থাটি কীভাবে গড়ে তুলতে হবে তারও নির্দেশ দিতে থাকলেন। এ সূরার শেষ ২৩টি রুকুতে বেশি অংশে এ নির্দেশ ও বিধান বয়ান করা হয়েছে।
হিজরতের পর ইসলাম ও কুফরের লড়াইও একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছল। হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াত কুফরের ঘরে দেয়া হচ্ছিল। তখন বিভিন্ন গোত্রের যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করত তারা নিজেদের জায়গায় দ্বীনের প্রচার করত। এর জবাবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কিন্তু হিজরতের পর এ বিক্ষিপ্ত মুসলমান মদিনায় একত্র হয়ে একটি ছোট্ট ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ গঠন করার পর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেল। তখন একদিকে ছিল একটি ছোট জনপদ এবং অন্যদিকে সমগ্র আরব ভূখণ্ড তাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল।
গৃহহারা মানুষের শত্রুতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ার কারণে অভাব-অনটন ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল মুসলমান। চতুর্দিক থেকে বিপদ তাকে ঘিরে ধরছিল। এ অবস্থায় যেন সে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে পড়ে। পূর্ণ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতাসহ মোকাবেলা করে এবং নিজের সংকল্পে দৃঢ় থাকে।
মুসলমানের দাওয়াত ব্যর্থ করার জন্য যে কোনো দিক থেকে যে কোনো সশস্ত্র আক্রমণ এলে সাহসিকতার সঙ্গে তার মোকাবেলা করার জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হবে। বিরোধী পক্ষের সংখ্যা ও তাদের শক্তির আধিক্যের পরোয়া করা চলবে না।
মুসলমানের হৃদয়ে এমন হিম্মত সৃষ্টি করতে হবে, যাতে আরবের লোকেরা ইসলাম যে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে আপসে গ্রহণ করতে না চাইলে বল প্রয়োগে জাহেলিয়াতের বাতিল ব্যবস্থাকে মিটিয়ে দিতে সে ইতস্তত করবে না। এ সূরায় আল্লাহ এসব বিষয়ের প্রাথমিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
দাওয়াতের এ পর্যায়ে একটি নতুন গোষ্ঠীও আত্মপ্রকাশ শুরু করেছিল। এটি ছিল মুনাফিক গোষ্ঠী। নবী করিমের (সা.) মক্কায় জীবনের শেষের দিকেই মুনাফিকির প্রাথমিক আলামতগুলো স্পষ্ট হয়েছিল।
সূরা বাকারাহ নাজিলের সময় সবেমাত্র মুনাফিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাদের চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি স্পষ্ট হলে আল্লাহতায়ালা মুনাফিক গোষ্ঠীর প্রকৃতি অনুযায়ী পরবর্তী সূরাগুলোয় তাদের সম্পর্কে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা মুনফিক মুসলমান থেকে যেন সবাইকে হেফাজত করেন।
সূত্র : তাফসিরে ইবনে কাসির