ভারতকে যেসব কারণে আর ‘ছাড় দেবে না’ চীন !!

চীন এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করোনা মহামারীর ভেতর এই বিরোধ কেন তীব্রতা পেল? চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র দি গ্লোবাল টাইমসেও গত কয়েকদিনে ভারতকে লক্ষ্য করে আক্রমণাত্মক লেখালেখি হচ্ছে। তাহলে কি ভারতকে নিয়ে চীনের দীর্ঘদিনের নীতিতে পরিবর্তন আসছে? আর যদি হয় সেটা কেন? বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং গত সপ্তাহে চীনা সেনাবাহিনীকে ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকার’ পরামর্শ দেন। চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র দি গ্লোবাল টাইমসেও গত কয়েকদিনে ভারতকে লক্ষ্য করে একই ধরনের আক্রমণাত্মক লেখালেখি হচ্ছে। এগুলোকে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক ব্যাখ্যা করেছেন, সীমান্তে নতুন করে শুরু হওয়া সংকটে ভারতের প্রতি চীনের প্রচ্ছন্ন একটি হুমকি হিসেবে। কিন্তু কেন?

পশ্চিমা এবং ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক লিখছেন, বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বলয় বিস্তারের চেষ্টা চীন বেশ কিছুদিন ধরে করে চলেছে। করোনা মহামারী নিয়ে সারা বিশ্ব যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন বেইজিং এটাকে একটা লক্ষ্য হাসিলের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে। তার বলছেন, শুধু সীমান্তে চাপ তৈরি নয়, হংকংয়ে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন। এসব পর্যবেক্ষক বলছেন, ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরও সংকটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ-সাহায্য দিয়ে অনেকটা একইভাবে বেইজিং তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখ সীমান্তের গালোয়ান উপত্যকায় গত কয়েক বছর ধরে ভারত যেভাবে রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো তৈরি করছে তাতে চীন সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। তারা ভারতের এই কর্মকাণ্ড তারা আর মেনে নিতে রাজি নয়।

কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, চীন ও ভারতের সীমান্ত রেখা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ ঐতিহাসিক। কিন্তু গত ১০-১২ বছরে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে ভারত যেভাবে ব্যাপক হারে অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে তাতে চীন বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ভারতে কট্টর জাতীয়তাবাদী একটি সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিক নৈকট্যে বেইজিংয়ের উদ্বেগ দিন দিন আরও বাড়ছে।

হংকং-ভিত্তিক এশিয়া টাইমসে এক লেখায় সুইডিশ বিশ্লেষক বার্টিল লিনটার বলছেন, লাদাখে ভারতের সড়ক নির্মাণকে চীন একটি হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাশগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে মহাসড়ক চীন তৈরি করেছে, তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

এমনিতেই এই দুটো প্রত্যন্ত প্রদেশ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়ে চীন সবসময়েই উদ্বেগে। উপরন্তু এই মহাসড়কটি আকসাই চীন নামে যে এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে সেটিকে ভারত তাদের এলাকা বলে বিবেচনা করে। এলাকাটি ভারতীয় মানচিত্রের অংশ। লিনটার বলছেন, সেই অঞ্চলের কাছে ভারতের অবকাঠামো নির্মাণের তৎপরতা চীন মেনে নিতে পারছে না। চীনের গ্লোবাল টাইমসে গত কয়েক দিনে বেশ কিছু সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়তে ভারতের বিরুদ্ধে এমন সব কড়া কড়া ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। গত ১৯ মে প্রকাশিত সংখ্যায় তারা লাদাখের গালোয়ান উপত্যকায় ‘অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা’ তৈরির জন্য ভারতকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছে।

এতে বলা হয়েছে, ‘ভারত যদি উসকানি অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হবে।’ চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্রের এ ধরনের কথাবার্তাকে অনেক বিশ্লেষক বিরল হুমকি হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। চীন ও ভারতের মধ্যে তাদের ১৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫০০০ বর্গমাইল এলাকাকে ভারত তাদের এলাকা বলে দাবি করে। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলকে চীন তাদের এলাকা বলে মনে করে।

সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে ১৯৬২ সালে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে ভুটানের সীমান্তে দোকলাম নামক একটি এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি নিয়ে চীন ও ভারতের সৈন্যরা ৭২ দিন ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখে ভারতের রাস্তা নির্মাণ ছাড়াও ভারত চীনের জন্য অন্য মাথাব্যথারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোট বেঁধে চীনকে কোণঠাসা করার যে চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে, ভারতকে সেই জোটের অংশ হিসেবে দেখছে চীন।

ভারত-চীন বৈরিতা নিয়ে একটি গবেষণা-ধর্মী বইয়ের লেখক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, ‘চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাগে আনার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে একটি অক্ষশক্তি তৈরি করেছে, ভারত তার অগ্রভাগে।’ ‘আমেরিকা মনে করে চীনকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে যে দেশটি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে সেটি হলো ভারত। এজন্য গত ১০ বছরের তারা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে’ যোগ করেন তিনি।

গ্লোবাল টাইমস সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন লেখায় এমন কিছু মন্তব্য এবং তুলনা টেনেছে, যাতে বোঝা যায় যে, ভারতকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন বিরোধী একটি অক্ষের অংশ হিসেবে মনে করছে। গত ২৫ মে চীনা বিশ্লেষক লং শিং চুং এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখেন, ‘ভারত সরকার যেন তাদের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কামানোর গোলা হিসেবে ব্যবহৃত না হতে দেন।’ ‘যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার দুই দেশকেই সতর্ক থাকবে হবে, কারণ যে কোনো সুযোগেই শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাব’ সতর্ক করেন তিনি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *